তিন শতকের ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০; সময়: ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ |
তিন শতকের ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সমাজে পরস্পরের প্রতি নির্ভর করার সম্পর্ক আর ব্যক্তি স্বাধীনতার মাঝে সব সময়েই উত্তেজনা সৃষ্টি করে এসেছে মহামারি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নানা প্রচেষ্টা। আজকের বিশ্বে যা হচ্ছে; তা নতুন নয়, বরং সেই সুদূর অতীতেরই প্রতিচ্ছবি।

টিকা বিরোধীতা এমন একটি বিষয় যা আমাদের এসব আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দেয়। বিশেষ করে; অধুনা বিশ্বে পঞ্চম প্রযুক্তির ইন্টারনেট সংযোগ, মাস্ক এবং টিকা বিরোধিতার অদ্ভূত সমন্বয়ে চলছে অ্যান্টি ভ্যাক্সার নামের টিকা বিরোধী আন্দোলনগুলি। একটি দেশের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের জন্যও তারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যুগে যুগে অন্য সব ইস্যুর চাইতে বেশি সমস্যা তৈরির রেকর্ড আছে টিকাদান কর্মসূচী নিয়ে। ঝড়ো বিদ্যুৎকে যেমন লৌহদণ্ড আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি নতুন টিকা মানেই নতুনতর প্রতিবাদের জোয়ার। পুরোনো সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে রোগের প্রতিষেধককে হুমকি রূপে দেখা হয় দেশে দেশে।

ইতিহাস যা বলছে:

এমন কথা জানিয়েছেন মানব শরীরবৃত্তীয় বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক জনাথন বারম্যান। তার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, উনিশ শতকে যারা ইংল্যান্ডে গুটিবসন্ত টিকা কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের জন্য এটা প্রথম আন্দোলন ছিল না। ইতোপূর্বে, ১৮৩৪ সালে এসব জনগোষ্ঠী ‘পোর ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ নামক একটি বিল পাসের বিরোধিতা করেছিলেন, যার আওতায় বেকার জনগোষ্ঠীকে খাদ্যের জন্য সরকারি কর্মশালায় কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। ওই সব কর্মশালার পরিবেশ ছিল শোচনীয়। অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া-সহ, শিশুশ্রম এবং পরিবারের সদস্যদের একে-অপর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ঘটনাও ছিল স্বাভাবিক।

দরিদ্র লোকেদের স্বাধীন জীবনের উপর বাধ্যতামূলক টিকা নেওয়ার ঘোষণাকেও আন্দোলনকারীরা নতুন কর্তৃত্ববাদ রূপে দেখলেন। ইংল্যান্ডে এমন বিরোধিতার ঘটনা উল্লেখ করে, তারপর ১৯ এবং ২১ শতকের প্রথমভাবে যুক্তরাষ্ট্রে টিকা নিয়ে নাগরিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন বারম্যান।

১৮০২ সালে আঁকা এক ক্যারিক্যাচার চিত্রে গোবসন্তের জীবাণু গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার বিদেশী পদ্ধতির কাল্পনিক প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। ছবি: লাইব্রেরি অব কংগ্রেস

 

 

দুই শতাব্দী ধরে পৃথিবীর অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে টিকা নিয়ে মনোভাব বোঝা খুবই দরকারি। কারণ, বিশ্বায়নের যুগে শীর্ষ অর্থনীতিটির সাংস্কৃতিক প্রভাবও কম নয় এবং পশ্চিম গোলার্ধের নানা দেশের সঙ্গে অভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে আবদ্ধ অধিকাংশ মার্কিনী জনতা। আবার এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানের সঙ্গে অভিবাসন,অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং ভূ-কৌশলগত মিত্রতাও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

এটা জানতে প্রথমেই যে প্রশ্ন করা দরকার, তা হলো; মার্কিন ইতিহাসে টিকা বিরোধীতার সূত্রপাত কোথা থেকে? উত্তর দিয়েছেন বারম্যান নিজেই। তিনি জানান, টিকা আবিষ্কারের প্রাথমিক যুগ থেকেই এর সূত্রপাত। টিকা আবিষ্কারের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবদেহে কোনো একটি জীবাণুর বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে শুধু দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নতুন জীবাণুর হুমকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, তাকে এটি প্রতিরোধে উদ্দীপ্ত করা হয়। সীমিত মাত্রায় এ সংক্রমণ ঘটানোকে বলা হয়- ভেরিওলেশন।

ষোড়শ শতাব্দীতেই আফ্রিকা এবং এশিয়ায় গুটিবসন্ত নির্মুলে আক্রান্ত রোগীর ফোঁড়ার পুঁজ বা গুটি হওয়া চামড়া- সুস্থ ব্যক্তির ত্বকে সামান্য পরিমাণে ঘষে এধরনের প্রতিরোধ উদ্দীপ্ত করার পদ্ধতি ছিল। আঠারো শতকের শুরুর দিকে বোস্টনে এই ধারণাটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেন খৃস্ট ধর্মযাজক কটন মাথের। নিজ বাড়িতে কাজ করা ওনেসিমাস নামের এক আফ্রিকান দাসের কাছ থেকে তিনি এ সম্পর্কে জেনেছিলেন। এই চর্চাটি পরবর্তীতে গুটিবসন্তে মৃত্যুর হার অনেক কমালেও, এর প্রচলনের জন্য ম্যাথের’কে বিদ্রূপ ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল অঢেল।

আঠারো শতকে প্রতিষেধক তৈরির জনপ্রিয়তা বাড়ান ইংরেজ চিকিৎসক অ্যাডওয়ার্ড জেনার। তিনিও ওই একই তত্ত্ব অনুসরণ করেন। কিন্তু, পদ্ধতিটি ছিল আরও বেশি বৈজ্ঞানিক। গুটিবসন্তের পুঁজের চাইতে তিনি বরং সাহায্য নিলেন গোবসন্তের জীবাণুর। গবাদি পশুতে দেখা দেওয়া এ বসন্তের জীবাণু দিয়ে সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করার পর পাওয়া গেল গুটিবসন্ত প্রতিরোধে আশ্চর্য সফলতা। পদ্ধতিটি সফল হওয়ার পরও, সাধারণ মানুষ একে তাদের ‘প্রাচীন সমাজ কাঠামোয় বিদেশী ব্যবস্থার আগ্রাসন’ হিসেবেই অবহিত করলো। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাকে অতীতেও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে ভ্যাকসিন প্রসঙ্গ।

১৯১৮ সালে কানাডার টরেন্টোয় বাধ্যতামূলক গুটিবসন্ত টিকাগ্রহণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি: শাটারস্টক
বিশ্বাস এবং সন্দেহ:

 

 

বর্তমানে টিকার নিরাপত্তা নিয়ে অতীতের এসব ঘটনার সামঞ্জস্যতা বেশ পরিষ্কার। হাম, মাম্পস এবং রুবেলা টিকা (এমএমআর) কর্মসূচীর পর এসব রোগের প্রকোপ কমে যুক্তরাজ্যে। তবে হামের প্রাদুর্ভাব কিছুদিন পর আবারও বাড়ে। ২০১২ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ২,০৩২টি হামের সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়। অর্থাৎ, যৌথ এমএমআর টিকাটি সম্পূর্ণ সফল হয়নি।

পৃথিবীজুড়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকার বিপুল চাহিদার এ যুগেও গত মার্চের এক জরিপে অংশ নেওয়া ২৬ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক ফরাসী নাগরিক জানান, টিকা আসলেও তারা সেটা নিতে রাজি নন। এর দুইমাস পর যুক্তরাষ্ট্রে করা এক জরিপেও একই উত্তর দেন ১৪ শতাংশ মানুষ।

এখানে যুক্তরাজ্যের টিকা কর্মসূচীর আংশিক ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করার কারণ, রাষ্ট্রীয় এ সিদ্ধান্ত যখন কোনো রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, তখন অনেকের মনেই সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ জন্ম নেয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বা নাগরিকদের আচরণ পরিবর্তন করার মতো গুণাগুণ টিকার আছে বলেও ধারণা করেন অনেকে। এটাই রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিক আস্থার অভাববোধ তুলে ধরে।

এনিয়ে বারম্যানের গবেষণা অনলাইন বা পারিবারিক কোনো জমায়েতে যারা টিকা বিরোধী প্রচারণা ঠেকাতে চান, তাদের সাহায্য করবে।

সরকারের বিরুদ্ধে টিকা বিরোধী- অ্যান্টিভ্যাক্স’দের নানা উদ্ভট প্রচারণা আছে। এমনই একটি তথাকথিত ‘কেলেঙ্কারি’র কথা বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)-কে নিয়ে। ২০১৬ সালে ভ্যাক্সেড নামে এক চলচ্চিত্রের সুবাদে এ ধারণা আরও ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৪ সালে জীববিজ্ঞানী ব্রায়ান হুকার সিডিসি’র ২০০৪ সালের একটি গবেষণার তথ্য পুনঃবিশ্লেষণ করে প্রকাশ করেন। তিনি ওই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দাবি করেন যে, ৩ বছরের কম বয়সী এমএমআর ভ্যাকসিন নেওয়া আফ্রিকান আমেরিকান শিশুদের মধ্যে পরবর্তীকালে মানসিক বিকলাঙ্গতার হার বাড়ে।

হুকার এবিষয়ে তার গবেষণার সহ-লেখক এবং সিডিসি’র বিজ্ঞানী উইলিয়াম থম্পসনের গোপন স্বীকারোক্তির রেকর্ডিংও শেয়ার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন নিজ দাবি প্রমাণ করার চেষ্টায়।

তবে বারম্যান জানাচ্ছেন, হুকারের গবেষণায় পদ্ধতিগত ত্রুটি ছিল ব্যাপক। একারণেই পরবর্তীতে তিনি সেটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন, যার প্রতিশোধ নিতেই অমূলক প্রচারণা ছড়াতে থাকেন এ জীববিজ্ঞানী।

এমন ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রায়শই ঘটে, যা পারতপক্ষে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের শক্তিশালী করে। সরকার তথা কর্তৃপক্ষের প্রতি নাগরিক অনাস্থার কারণেই এমন প্রচারণাগুলো জনপ্রিয়তা পায়। তাছাড়া, মানুষের অজ্ঞানতা এবং প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন দেখতে না চাওয়াটাও আরেকটি বড় সমস্যা।

তাই বলা যায়, চলতি শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোভিড-১৯ গণটিকা কর্মসূচী সফল করতে হলে, সমাজের সকল শ্রেণির কাছে সম্ভাব্য ভ্যাকসিন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য এবং স্বচ্ছ তথ্যাবলী উপস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরাটাও জরুরি, অন্ধবিশ্বাস রুখে শিক্ষার আলো বিস্তারের প্রচেষ্টায়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে