আকাশ থেকে যেভাবে নিখোঁজ হন প্রথম নারী বৈমানিক

প্রকাশিত: ০১-০৯-২০২০, সময়: ১৭:০১ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিমানে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া প্রথম নারী যাত্রী ছিলেন অ্যামেলিয়া মেরি ইয়ারহার্ট। লকহিড ইলেক্টা বিমানে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই তিনি নিখোঁজ হন। তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় ১৯৩৯ সালের ৫ জানুয়ারি। তখন তার বয়স ছিলো ৩৯। তবে কীভাবে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান তা আজো যেন এক রহস্য। তার আগে জেনে নিন অ্যামেলিয়া মেরি ইয়ারহার্ট সম্পর্কে-

অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের পুরো নাম অ্যামেলিয়া মেরি ইয়ারহার্ট। ১৮৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসের আচিসনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ছিলেন রেলপথ বিষয়ক আইনজীবী এবং মা ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে। শৈশব থেকে ইয়ারহার্ট ছিলেন দুঃসাহসী এবং স্বাধীনচেতা, যা পরবর্তীতে তিনি পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছেন। ১৯১৫ সালে শিকাগোর হাইড পার্ক হাই স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ইয়ারহার্ট। এরপর তার মা পৈতৃক সম্পত্তি লাভ করলে পেনসিলভেনিয়ায় ওগনজ স্কুলে ভর্তি হন। তবে দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে কানাডার একটি সামরিক হাসপাতালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহতদের সেবায় নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে তিনি নার্সিংয়ের উপর পড়াশোনা করেন।

কানাডা থেকে ফিরে বোস্টনের ডেনিসন হাউস নামে একটি সেটেলমেন্ট হাউসের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এটি মূলত গত শতকের ২০ দশকে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় শুরু হওয়া সেটেলমেন্ট মুভমেন্টের অংশ ছিল। ইয়ারহার্টের বয়স যখন ১০ বছর, তখন তিনি এক মেলায় প্রথম বিমান দেখেন। প্রথম দেখায় বিমানকে তার কাঠ ও তারের জঞ্জাল মনে হয়েছিল। এর এক দশক পর সেই ইয়ারহার্টই বিমানের প্রেমে পড়ে যান। ১৯২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর, অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট প্রথম বিমানে ভ্রমণ করেন। পাইলট ফ্রাঙ্ক হকসের সেই ফ্লাইট ইয়ারহার্টের জীবন বদলে দিয়েছিল। সেদিন থেকেই তার মধ্যে বিমান চালানোর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পরের বছর ৩ জানুয়ারি, তিনি বিমান চালানোর প্রথম প্রশিক্ষণ নেন।

পরবর্তী ছয় মাস তিনি টাকা জমিয়ে নিজের প্রথম বিমান কেনেন। যেটি ছিল কিনার এয়ারস্টারের দুই আসনের একটি পুরনো বিমান। ইয়ারহার্ট হলুদ রঙের সেই বিমানের নাম দিয়েছিলেন দ্য ক্যানারি। এই বিমানে চড়েই তিনি প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে এক লাখ ৪০ হাজার ফুট উপর দিয়ে বিমান চালানোর রেকর্ড করেন। এরপর ১৯২৮ সালের এপ্রিলের এক বিকেলে ইয়ারহার্ট একজন ফোন করে বলেন, আপনি কি প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে আটলান্টিক পাড়ি দিতে চান?

মজা ভেবে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে আগন্তুককে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। অতঃপর ফোনের অপর প্রান্তে থাকা লেখক ও প্রকাশক জর্জ পালমার পুটনাম যখন নিজের পরিচয় দিলেন, তখন ইয়ারহার্ট বুঝতে পারলেন এটি নিছক কোনো মজা নয়। পরবর্তীতে তিনি পুটনামের প্রস্তাবে রাজি হন এবং নিউ ইয়র্কে তার সঙ্গে দেখা করেন। তখন ইয়ারহার্টকে আরেক বৈমানিক উইলমার বিল স্টালজ এবং মেকানিক লুইস গর্ডনের সঙ্গে যোগ দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এরপর ১৯২৮ সালের ১৭ জুন, নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ট্রিপ্যাসি হার্বার থেকে ফকার এফ-৭ মডেলের ফ্রেন্ডশিপ নামের বিমান নিয়ে তিন জনের দলটি তাদের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করেন।

১৯৩৭ সালের ২ জুলাই কী ঘটেছিল?

ঘটনার দিনে লকহিড ইলেক্ট্রা টেন ই বিমান নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বের হন মার্কিন নারী বৈমানিক অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট। তার সঙ্গে ছিলেন নাবিক ফ্রেড নুনান। অ্যামেলিয়া অবশ্য এর আগেই বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন প্রথম নারী বৈমানিক হিসেবে একাকী আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে। বিষুবরেখা বরাবর পূর্বদিকগামী তার যাত্রাপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৯ হাজার মাইল। ১৯৩৭ সালে মার্চে বিমানে সমস্যার কারণে অ্যামেলিয়ার প্রথমবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিমান ঠিক করে একই বছরের ২১ মে নাবিক নুনানকে সঙ্গে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি।

৪০ দিনে মোট ২০ জায়গায় যাত্রা বিরতি দিয়ে অ্যামেলিয়া ও নুনান ২২ হাজার মাইল পাড়ি দেন। এরপর তারা পাপুয়া নিউগিনির পূর্ব উপকূলের লায়ে নামক এক স্থানে এসে পৌঁছান। এরপর ২ জুলাই সকালে তারা দু’জন সফরের সবচেয়ে কঠিনতম পথে যাত্রা শুরু করেন। তাদের গন্তব্য ছিল লায়ের মূল ভূখণ্ড থেকে ২৫০০ মাইল দূরে মধ্য প্রশান্ত সাগরে ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রবালদ্বীপ হাউল্যান্ড। এই দ্বীপে যাত্রাবিরতি করে পুনরায় বিমানের জ্বালানি ভর্তি করার কথা ছিল ইয়ারহার্ট ও নুনানের। সেই লক্ষ্যে তারা দু’জন এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের পথ দেখাতে সাহায্য করছিল ইটাসকা নামের এক জাহাজ। ইয়ারহার্ট ও জাহাজের নাবিক রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে উভয়ে হাউল্যান্ড দ্বীপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

কয়েক ঘণ্টার যাত্রা শেষে ইয়ারহার্ট ও নুনান যখন দ্বীপের নিকটবর্তী হন তখন নিয়মিত জাহাজের নাবিককে রেডিও সিগনাল পাঠাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে সিগনাল অনেক জোরালো হয়ে আসলে জাহাজের রেডিও সিগনাল অপারেটর দৌড়ে ডেকে আসেন। এরপর তিনি আকাশের চতুর্দিকে ইয়ারহার্টের বিমান খুঁজতে থাকেন। কোনো কিছু দেখতে না পেয়ে তিনি বিমানে একের পর এক সিগনাল পাঠাতে থাকেন। তবে তার কোনোটাই আর ইয়ারহার্ট ও নুনান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এমনকি ইয়ারহার্টের লকহিড ইলেক্ট্রাও হাউল্যান্ড দ্বীপে পৌঁছায়নি।

ব্যাপক অনুসন্ধানের পরও ইয়ারহার্ট, নুনান কিংবা বিমানের কোনো একটি অংশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুই সপ্তাহের অনুসন্ধান শেষে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট এবং ফ্রেড নুনান বিমানসহ সাগরে বিধ্বস্ত হয়ে হারিয়ে গেছেন। তাদের ধারণা মতে, ইয়ারহার্ট জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। ফলে দিক ভুলে তারা অন্যদিকে চলে যান। এবং একপর্যায়ে বিমানের তেল শেষ হয়ে যাওয়ায় তা প্রশান্ত মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের নানা অর্জন

আমেরিকান বিমানচালনার পথিকৃৎ অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট বিমান চালিয়ে গড়েছিলেন বহু রেকর্ড। বিমানচালনার ক্ষেত্রে নিজের অর্জনের জন্য মার্কিন সরকার তাকে দিয়েছিল বিশেষ ‘ফ্লাইং ক্রস’। নিজের বিমানচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছিলেন অ্যামেলিয়া। যা জায়গা করে নেয় আমেরিকার বেস্টসেলার বইগুলোর তালিকায়। তাছাড়া বিমানচালিকাদের সংগঠন দ্য নাইনটি-নাইনস গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।

অ্যামেলিয়া আমেরিকার পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি মেম্বার হন ১৯৩৫ সালে। সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের বৈমানিক প্রকৌশল এবং ক্যারিয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিতেন তিনি। নারী-পুরুষ সমতায় বিশ্বাসী অ্যামেলিয়া নিজের দেশের জাতীয় নারী সমিতির সদস্য ছিলেন এবং সমান অধিকার সংশোধনী প্রণয়নের পক্ষের শুরুর দিককার একজন সমর্থক ছিলেন।

অ্যামেলিয়ার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

১৯৩৯ সালে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়। তবে তার অন্তর্ধান মানুষকে চমকে দিতে থাকে নানাভাবে এবং এই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চালু হয়ে যায়। অনেকেই বিশ্বাস করেন তার প্লেনটি প্যাসিফিকের একটি প্রান্তীয় প্রবাল দ্বীপে অবতরণ করেছিল। সেখান থেকে জাপানি সেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। তারপর বহু বছর বন্দি থেকে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন এই নারী। আবার অনেকে বলেন বেঁচে গিয়েছিলেন অ্যামেলিয়া, তার পর নতুন পরিচয় গ্রহণ করে বাকিটা জীবন কাটিয়েছেন। এ রকম আরো নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে, তার অন্তর্ধান ঘিরে।

কোথায় গেলেন ইয়ারহার্ট?

বিগত ৮৩ বছর ধরে এই নারীর খোঁজ চলছে। প্রথম উত্তরটা মেলে দুই বছর আগে। দাবি করা হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে নিকুমারোরো দ্বীপে তার কঙ্কাল মিলেছে। অ্যামেলিয়ার ব্যবহৃত প্রসাধনীরও হদিস মিলেছে বলে দাবি করা হয়। সেই দাবি যখন অনেকে মেনে নিতে শুরু করেছেন, তখনই এক বিমানের ধ্বংসাবশেষ ঘিরে উঠে আসে নতুন প্রশ্ন। পাপুয়া নিউ গিনির কাছে সমুদ্রে খোঁজ মেলে একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষের। প্রথমে জাহাজ বলে মনে হলেও বিশেষজ্ঞরা এখন মোটামুটি নিশ্চিত, এটি একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ। জানা যায়, ওই ধ্বংসাবশেষ ১৯৩৭ সালে হারিয়ে যাওয়া অ্যামেলিয়ার বিমান হতে পারে।

১৯৩৭ সালে অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্ট প্রশান্ত মহাসাগর থেকে হাউল্যান্ড যাওয়ার পথে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ৮১ বছর আগের সেই উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষকেই প্রথমে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ভেবেছিলেন উদ্ধারকারীরা। প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম স্নাভেলি দাবি করেছেন, এটি বিমানই। তবে ডাইভারদের তা নিশ্চিত করার জন্য আরো ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে। তাকে সে সময় সমর্থন করেন আরো কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।

বার্নাকল দিয়ে আবৃত পুরনো কাচের অংশ মিলেছে এখান থেকে। ১৯৩০ সাল নাগাদ যে ধরনের বাতি ব্যবহার করা হয় বিমানে, তেমন কিছুও মিলেছে। এই ধরনের বাতিকে লকহিড লাইট বলা হত। একটা কাচের চাকতির মতো অংশ মিলেছে, যেটি দেখে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই ধ্বংসাবশেষ ইয়ারহার্টের বিমানেরই। তবে এই বিমানে তিনিই ছিলেন কি না, তা নিয়ে দীর্ঘ দুই বছর ধরে চলছে গবেষণা। ধারণা করা হয়, তার বিমান লকহিড ইলেকট্রা এল-১০ই-র জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। এই নারী নিখোঁজ হওয়ার পর সন্ধান চললেও তাকে না পাওয়ায় মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে