ভিওআইপি সম্রাটদের দখলে টেলকো সেক্টর

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২০; সময়: ১:১৯ অপরাহ্ণ |
ভিওআইপি সম্রাটদের দখলে টেলকো সেক্টর

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিটিসিএল, টেলিটক ও ডটসহ তিন কোম্পানিজুড়ে দুর্নীতির মহোৎসব, পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিতে সব ব্যবস্থা থাকা

টেলকো সেক্টরের ৩টি কোম্পানিই এখন অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) সম্রাটদের দখলে। কোম্পানি ৩টি হল-বিটিসিএল, টেলিটক এবং ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম (ডট)।

শুধু ভিওআইপি বাণিজ্যই নয়, এই ৩ কোম্পানির শীর্ষ পদগুলো দখলে রাখা ব্যক্তিরা বিরোধীদলীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার অর্থের জোগানও দিচ্ছেন।

মুখে ক্ষমতাসীন দলের মুখোশ পরলেও কেউ কেউ রাতের অন্ধকারে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গ দিতে ব্যস্ত। মূলত ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো তুলে দিচ্ছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের হাতে।

বিনিময়ে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ ছাড়া তাদের পছন্দের কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ যাতে কাজ না পায়, সেভাবে প্রকল্পের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয়।

এভাবে কোম্পানি তিনটি জুড়ে চলছে দুর্নীতি-লুটপাটের মহোৎসব। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে বিদেশে টাকা পাচারের গোপন কারবার।

ক্ষমতার শীর্ষ পদে বসে অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা একাধিক বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিচ্ছেন।

ফলে সরকারি কোম্পানিগুলো এখন খাদের কিনারে গিয়ে ঠেকেছে। এহেন গর্হিত কাজ করে প্রকারান্তরে তারা নিজেদের গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতি-লুটপাট আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সরকারি ফোন কোম্পানি টেলিটকের এখন গ্রাহক নেই বললেই চলে। যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই কোম্পানি।

ওদিকে বিটিসিএলের ল্যান্ডফোন গ্রাহক সংখ্যাও কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। টেলিফোন শিল্প সংস্থা টেসিসের কোনো কাজ নেই। দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকম (ডট)।

এ প্রসঙ্গে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন বলেন, তার জানামতে বিটিসিএলে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে না। তিনি যোগদানের পর থেকে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণও বেড়েছে।

অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্য এখন নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বেসরকারি কোনো কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারে, তাহলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, টেলিটকের প্রতিটি প্রকল্প ইজিপি পদ্ধতিতে উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে হাতে নেয়া এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

লিথিয়াম ব্যাটারির কাজও সম্পূর্ণ স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। এ খাতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে টেলিটকের কোনো কাজ দেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া।

জানা গেছে, বিটিসিএলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাওয়া ভবনের প্রভাবশালী এক নেতার প্রয়াত ছোট ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ওই ছোট ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বিটিসিএলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন।

সে সময় বিটিসিএলে গডফাদার হিসেবে তাকে আগলে রেখেছিলেন সে সময়ের অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের জনক মোহাম্মদ তৌফিক।

বর্তমানে এই তৌফিক দেশের বাইরে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এই গডফাদারের সিন্ডিকেট সে আমলে শুধু অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে এই খাত থেকে হাতিয়ে নেয় কয়েকশ’ কোটি টাকা।

হাওয়া ভবনের শেল্টার থাকায় এদের বিরুদ্ধে ওই সময় কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, ভিওআইপি তৌফিকের ডানহাত হিসেবে পরিচিত সেই কর্মকর্তাই এখন বিটিসিএলের একটি প্রভাবশালী পদে।

সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের জার্সি পরে তদবিরের মাধ্যমে বিটিসিএলের ওই পদ বাগিয়ে নেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিটিসিএলের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্য অনেক সিনিয়র ও দক্ষ কর্মকর্তা থাকলেও তাদের ডিঙিয়ে তিনি নিয়োগ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হন।

এ কাজে তাকে সহায়তা করে অবৈধ ভিওআইপি গডফাদার ও তার নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি। নিয়োগ পেয়েই তিনি পুরো বিটিসিএলে প্রভাব বলয় তৈরি করেন।

প্রতিটি বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় নিয়ে আসেন তার সিন্ডিকেট সদস্যদের। যার কারণে অনেক দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা এখন কাজবিহীন পদে অলস সময় কাটাচ্ছেন।

যেসব বিভাগের সঙ্গে অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তার সব পদেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে ওই শীর্ষ কর্মকর্তার সিন্ডিকেট সদস্যদের।

যার কারণে বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কল কমে এখন প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক কলের বেশিরভাগই এখন অবৈধ পথে ভিওআইপির মাধ্যমে আসা-যাওয়া করছে।

আর এ খাতের আয় পুরোটাই এখন চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। দেশের বাইরে বসে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন সেই গডফাদার তৌফিক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিটিসিএলের বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার পছন্দের কোম্পানিগুলো।

কারণ, হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রকল্পগুলোর দরপত্রের স্পেসিফিকেশন এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে তার পছন্দের কোম্পানি ছাড়া অন্য কেউ কাজ না পায়। কিছু কিছু প্রকল্পের শর্ত সেভাবেই করা হয়েছে।

এভাবে টেন্ডার স্পেসিফিকেশন তৈরিতে সহায়তা করছেন তারই সিন্ডিকেটের একজন সদস্য, যিনি বিটিসিএলের প্রকিউরমেন্ট বিভাগে কাজ করছেন।

অভিযোগ উঠেছে, প্রকিউরমেন্ট বিভাগের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবশালী নেতাদের অর্থের জোগান দেয়ার অভিযোগ আছে।

গত নির্বাচনেও এই সিন্ডিকেট সিরাজগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া এক এমপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। তার নির্বাচনে খরচ হওয়া ৯০ শতাংশ টাকা চক্রটি জোগান দেয় বলে অভিযোগ আছে।

ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমের (ডট) একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটভুক্ত দেশি-বিদেশি কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে চক্রটি ৩ কোম্পানির ৪১০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

চীনের একটি কোম্পানির মাধ্যমে ৫জি প্রকল্পটি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অভিযোগ আছে, এই সিন্ডিকেট দেশীয় একটি কোম্পানিকে ৯৪ কোটি টাকার কাজ দিয়েছে ডিরেক্ট পার্সেজ মেথডের (ডিপিএম) মাধ্যমে।

এ প্রক্রিয়ায় আরও ১০০ কোটি টাকার কাজ দেয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রাইমারি শিক্ষায় ট্যাব দেয়ার নামেও ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে একটি দেশীয় কোম্পানির যোগসাজশে।

টেলিটক থেকে লিথিয়াম ব্যাটারি সরবরাহের কাজটিও একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে করানো হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, টেলিটকের এক শীর্ষ কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় বুস্টার নামে সাবেক এক ছাত্রদল ক্যাডারের মাধ্যমে পুরো টেলিটকে দখলের রামরাজত্ব কায়েম করা হয়েছে।

এদিকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার এসব আন্ডারগ্রাউন্ড সম্রাটের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ৯টি দেশের গোয়েন্দারা। এ ছাড়া কানাডার অ্যান্টিফ্রড ডিপার্টমেন্ট, মনিটরিং অথরিটি অব সিঙ্গাপুর, ইন্টারন্যাশনাল রেভিনিউ সার্ভিসেস (আইআরএস), অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটি অব কানাডা (একরা)।

নেপাল সরকারি টেলিকম এসব ভিওআইপি ও সাইবার গডফাদারের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে। ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, নেপাল, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ডস, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ অন্তত ডজন খানেক দেশের টেলিকম কেলেঙ্কারিতে এদের কয়েকজনের নামও রয়েছে। অভিযোগ আছে, গত ১০ বছরে এই সিন্ডিকেট ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি কল টার্মিনেশন-অরিজিনেশন ও অবৈধ টেলিকম বাণিজ্য করেছে।

এই সিন্ডিকেট প্রতারণার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে সিংটেলের মাধ্যমে আইপিএলসি (ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিজ লাইন) এনে কল টার্মিনেশনের পাশাপাশি অন্য টেলিকম কোম্পানি ও আইএসপি কোম্পানিগুলোর কাছে কোটি কোটি টাকার ব্যান্ডউইথ বিক্রি করত।

সরবরাহ করত ভিওআইপি ইকুইপমেন্ট সেঙ্গোমা পিসি ও সিগনাল লজিক ও সুপার মাইক্রো সার্ভিস সিস্টেম। কম্পিউটার আইটেমের নামে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এবং বিটিসিএলের ইকুইপমেন্ট দেখিয়ে তারা এসব অবৈধ কল টার্মিনেশনের যন্ত্রপাতি আমদানি করত।

বেআইনি ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বিটিসিএল মগবাজার শাখার অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে