ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেভাবে মনে রাখবে ২০২০

প্রকাশিত: ২৮-১২-২০২০, সময়: ১৪:৪৩ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ২০১৯ সালের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের মানুষেরা অজানা অসুখে ভুগতে শুরু করে। গণমাধ্যমে একটু-আধটু সেই খবর আসতে শুরু করলেও কে ভেবেছিল পরবর্তী এক বছর গোটা বিশ্বকে তা নাড়িয়ে দেবে! ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে উহানের স্বাস্থ্য কমিশন নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ার কথা জানায়। পাঁচ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সংক্রান্ত প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই করোনা ভাইরাসের নাম দেয় সার্স-কোভ-টু। আর এর থেকে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯। ১২ জানুয়ারি ভাইরাসটির জিন রহস্য প্রকাশ করে চীন। তখন পর্যন্ত সেটি কিন্তু চীনবন্দিই ছিল। একদিন পরই প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে থাইল্যান্ডে। এরপর আর আটকে রাখা যায়নি ক্ষুদে সেই দানবকে।

প্রথম ধরা পড়ার ৪৭ দিনের মাথায় চীনে ৬৬ হাজার মানুষকে ভাইরাস আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়। মারা যান ১৫০০ জন। শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে নভেল করোনা। সংক্রমণ বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। মৃত্যুর খাতায়ও দৈনিক যোগ হতে থাকে কয়েক হাজার সংখ্যা। স্মরণকালে এমন মহামারির মুখোমুখি হয়নি মানুষ।

কাছে আসতে মানা

ঔষধ নেই, প্রতিষেধক নেই। কিভাবে রোখা যাবে এই ভাইরাসকে, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে। দেয়া হয় মানুষে-মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ। ব্যবধান রাখতে হবে দেড় থেকে দুই মিটার, যার নাম দেয়া হয় ‘সামাজিক দূরত্ব’। গোটা পৃথিবীর চেহারা আর যোগাযোগের ধরনটাই রাতারাতি বদলে যায় তাতে।

সৌজন্য হিসেবে হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানোর রীতিকে বিদায় জানায় মানুষ। তার বদলে সৌজন্য আর উষ্ণতা প্রকাশের অভিনব সব উপায়ও তারা বের করে। কেউ মুষ্টিবদ্ধ হাত মেলায়, কেউবা কনুই, আবার হাতের বদলে পায়ে-পায়ে স্পর্শেরও চল দেখা যায়। তবে দূরে দাঁড়িয়ে মৌখিকভাবে সৌজন্য প্রকাশই নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

মাস্ক যখন পরিধেয়

মাস্ক পরলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায় কিনা শুরুতে এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। কিন্তু একে একে সব দেশ জনপরিসরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সবার মাস্ক পরার পক্ষে মত দেয়। সংস্কৃতি ভেদে পোশাকে ভিন্নতা থাকলেও সারা বিশ্বেই মাস্ক হয়ে উঠে অপরিহার্য পরিধেয়।

যারা সুপারহিরো

করোনার বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে নামতে হয় চিকিৎসকদের। দেশে দেশে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবের মধ্যেই অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে কঠিন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যকর্মীরা। অন্যকে বাঁচানোর সেই চ্যালেঞ্জে অনেকেই জীবন দেন। লকডাউনে তাদের প্রতি নানা উপায়ে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা জানাতে ভোলে না বিভিন্ন দেশের কৃতজ্ঞ মানুষেরা।

এত কিছুর পরও ঠেকানো যায়নি সংক্রমণ, থামছিল না মৃত্যুর মিছিলও। লাগাম ধরতে দেশে দেশে চলে লকডাউন। সীমান্তে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনৈতিক আর বিনোদনমূলক সব কর্মকাণ্ড। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পুঁজিবাজারগুলোর লেনদেনে লাগে সবচেয়ে বড় ধাক্কা।

আশাহীন সময়েও মানুষ আনন্দে বাঁচার উপায় ঠিক খুঁজে নেয়। স্পেন, ইটালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ঘরবন্দি মানুষেরা ব্যালকনিতে কনসার্ট জমিয়ে ফেলে। অনলাইনে ডুব দেয়া মানুষকে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে নানাভাবে বিনোদিত করার চেষ্টা করেন তারকারাও।

আধুনিক জীবনযাত্রার চাপে কোণঠাসা প্রকৃতি যেন এই দফা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ারই তো তার সময়। কোনো কোনো নির্জন মহানগরীর বুকে এমনকি বুনো প্রাণীরাও নেমে আসে। আর গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ সাত ভাগ কমেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন রেকর্ড।

পড়তি ঢেউ

আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেখাচিত্র জুন নাগাদ নামতে শুরু করে। ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেয় দেশগুলো। শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত। খুলে দেয়া হয় এয়ারপোর্ট। কিন্তু এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় মহামন্দার সময়ের পর সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক সাত ভাগে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনে বিগত দেড় দশকের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে থাকে।

আন্তর্জাতিক সিরিজ বা বিভিন্ন লিগের খেলা হবে, অথচ মাঠে দর্শক থাকবে না- অন্য সময় হলে এমন কথা বললে সেটি নির্ঘাত উদ্ভট শোনাতো। অথচ ২০২০ সালে ইউরোপীয় ফুটবল লিগ কিংবা আইপিএলসহ বিভিন্ন ক্রীড়া আসর অনুষ্ঠিত হয় স্টেডিয়ামে শূন্য বা সীমিত দর্শক উপস্থিতি নিয়ে।

দ্বিতীয় ঢেউ

শীতের মৌসুমে বিভিন্ন দেশে নভেম্বর থেকে নতুন করে বাড়তে শুরু করে করোনার প্রকোপ। এই ধাক্কায় আবার বিপর্যস্ত ইউরোপ। একে একে আবারো লকডাউনে ফিরে দেশগুলো। শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়, যেটি আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ঘটায়।এ কারণে নতুন করে ব্রিটেনের সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয় বিভিন্ন দেশ।

একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন থেকে শুরু করে পরীক্ষা- সবগুলো ধাপ পেরিয়ে সরবরাহ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে। কিন্ত এক বছরের কম সময়ে একাধিক ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেন বিজ্ঞানীরা। ডিসেম্বর থেকেই কয়েকটির প্রয়োগ শুরু হয় দেশে দেশে। করোনার অন্ধকার এক টানেলের যাত্রা দিয়ে ২০২০ সালের সূচনা হলেও, বিদায়টা হয় শেষ প্রান্তে টিকার আলোতে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে