রাজশাহীতে অঞ্চলে মৌলবাদীদের নতুন ছক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১; সময়: ৪:২৮ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে অঞ্চলে মৌলবাদীদের নতুন ছক

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী অঞ্চলে জামাত-শিবির ও হেফাজত ফের নতুন কৌশলে নিজেদের সংগঠিত করছে। নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গত কয়েক বছর ধরে জামাত রাজশাহী অঞ্চলে বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

ফুড প্রসেসিং, কৃষিজ শিল্প, সুপারশপ, রিয়েল এস্টেট থেকে শুরু করে নেভিগেশন ব্যবসায়ও তাদের এই অর্থলগ্নি রয়েছে। তাদের নতুন ছকে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতার অংশীদারিত্বও তৈরি করা হয়েছে।

এদিকে, হেফাজত নেতারা নিজেদের সংগঠনকে আড়াল করে ক্বওমী মাদ্রাসা কেন্দ্রিক নতুন নামের সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’ নামের এই সংগঠনটিও রাজশাহীতে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতাকে নিজেদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নতুন ছক কষছে।

মৌলবাদী গোষ্ঠীর এই নতুন ছক ভাঙতে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজশাহী মহানগরীতে চলতি মাসেই এক জামাত ও চারজন ছাত্রশিবির নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) জানিয়েছে, তাদের সবাইকেই সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর পরিকল্পনা তৈরির বৈঠক থেকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, গত মাসের শুরুর দিকে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাউদ্দিন আইউবী রাজশাহীতে এসেছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বুধপাড়া এলাকার একটি বাড়িতে বসে ওইদিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন।

এই বৈঠকে সংগঠনটির সভাপতি ‘সাইড সংগঠন’কে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কথা বলেন নেতাকর্মীদের। এসব সাইড সংগঠনকে ভালো মানের জনশক্তি ও অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিয়ে এগিয়ে নেয়ার কথাও বলা হয়। বলা হয়, আরও বেশি নতুন নতুন সাইড সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে জোর দিতে হবে।

বৈঠকে বলা হয়, সংগঠনের তৎপরতা পরিচালনার জন্য অর্থের প্রবাহ যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়টি সামনের দিনগুলোতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। জনশক্তির ৯০%, সুধীদের ৮০% বিএম বা বাইতুল মাল (চাঁদা/অনুদান) আদায় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বলা হয়, আগামীতে রাজশাহীতে শক্তিশালী সাংগঠনিক তৎপরতার প্রয়োজন হবে।

সালাহউদ্দিন আইউবী বৈঠকে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন, সাবেকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রাজশাহীতে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সংগঠনের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে সেইসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে সভাপতি যাবার আগে সংগঠনের কর্মীদের তালিকা করে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মাঝে মোবাইল ফোন ও বাইসাইকেল বিতরণ করতে বলে যান। এরপর থেকে শিবির নেতারা রাজশাহীতে সেই কাজগুলো করছেন।

সূত্র মতে, পুরনো আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত হয়ে যাওয়ায় রাজশাহীতে গত ৫ বছরে জামাত ও শিবিরের পরিকল্পনায় বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বিপুল মুনাফাও করেছে। এর মধ্যে দুটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ হিসেবে অন্তত দেড় ডজন কোম্পানি তৈরি করেছে। সেগুলোর একটি ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে শুরু হয়।

তবে এর পেছনের মূল বিনিয়োগ জামাতের। তারা কৃষি থেকে শুরু করে খাদ্যপণ্যও তৈরি করছে। তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সদস্যদের চাকরি দেয়া হয়েছে। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের এক সাবেক নেতা ও ক্যাডার। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ্যাকশনে তাকে দেখা গিয়েছে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত।

বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে সেই গ্রুপ অব কোম্পানিজ। রাজশাহী ছড়িয়ে এখন দেশের অন্য এলাকাতেও তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে। এমনকি চারটি জাহাজ নিয়ে তারা নেভিগেশন ব্যবসাও শুরু করেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

আরেকটি গ্রুপ অব কোম্পানিজ এখন রাজশাহীর সব থেকে বড় সুপার শপ গড়ে তুলেছে। এর বাইরে তারা জড়িয়েছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসাতেও। বিপুল বিনিয়োগের পাশাপাশি মুনাফাও করছে। গড়ে তুলেছে রেস্টুুরেন্ট ব্যবসা। এই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একসময় জামাতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

রাজশাহীতে বিভিন্ন সময় ছাত্র শিবিরের সহিংসতায় তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পণ্য কেনার ভুয়া চালান কেটে টাকা জুগিয়েছেন। গ্রুপের চেয়ারম্যানও একসময় জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে ব্যবসায় সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের একটি স্যাটেলাইট সিটি প্রকল্প স্থাপন ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে ওই নেতাকে রাখা হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সেই কোম্পানি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজে নিবন্ধিত হয়েছে।

অন্যদিকে, রাজশাহীতে নতুন করে হেফাজতে ইসলামকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছেন দলটির নেতারা। সাম্প্রতিক আলোচিত হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের অনুসারী তারা। সরাসরি হেফাজতের নাম ব্যবহার না করে তারা ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’ নামের একটি নতুন সংগঠনের নামে তৎপরতা চালাচ্ছে। রাজশাহী মহানগরীর সরকারি দলের কয়েক নেতা ও কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তারা গড়ে তুলেছেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। গত দুবছর ধরে তাদের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ সহায়তাও নিয়েছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিএমএ মিলনায়তনে দিনব্যাপী ‘ওয়ায়েজ, খতিব ও দায়ী ওলামায়ে কেরামের করণীয়’ শীর্ষক এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেই কর্মশালায় সারাদেশ থেকে হাজারখানেক ক্বওমী মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অংশ নেন।

সেখানে হেফাজতে ইসলামের দুই নেতা মাওলানা মামুনুল হক ও মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ূবীকে প্রধান উপদেষ্টা করে ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ’ নামের একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে আলোচকরা দাবি করেন, ইসলামী কর্মকাণ্ডের ওপর প্রশাসনের নজরদারি প্রতিরোধে সংগঠনটি ‘আলেম ওলামাদের’ ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করবে।

সূত্র মতে, কেন্দ্রীয়ভাবে নতুন এই সংগঠন শুরুর পর হেফাজতে ইসলাম নেতা মামুনুল হকের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা কয়েক দফা রাজশাহীতে সফর করেন। এসময় তারা স্থানীয় পর্যায়ে হেফাজতের পরিচিত ও প্রথম সারির নেতাদের পাশাপাশি মাঝের সারির কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠক থেকে সংগঠনের স্থানীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর শাহমখদুম এলাকার জামিয়া দারুল উসওয়া মাদরাসায় কমিটি গঠনের জন্য হেফাজত নেতারা সমবেত হন। সেখানে ঢাকা থেকে আসেন রাবেতাতুল ওয়ায়েজিনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল বাসেত খান সিরাজী। এসময় তিনি নতুন এই সংগঠনকে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে উল্লেখ করেন। সে কারণে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারি দলের যেসব নেতা তাদের প্রতি অনুরক্ত তাদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। এসময় স্থানীয় নেতাদের বেশিরভাগই তাদের এই সংগঠনের কেন্দ্র হিসেবে নগরীর দড়িখরবোনা জামিউল-উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসাকে বেছে নেয়ার পরামর্শ দেন।

এর কারণ হিসেবে তারা জানান, এই মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) মুফতি আবদুস সবুর সিরাজীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। বিএনপির সাবেক মেয়র ও নগর কমিটির নেতার সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক আছে। জানা গেছে, রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন নামের সংগঠনটিকে হেফাজতের নেতারা একটি সিন্ডিকেট হিসেবে প্রতিষ্ঠান করেছেন, যাদের মূল লক্ষ্য দেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান মডেলের একটি রাষ্ট্র বানানো।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে