জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃষক বন্ধু ইউএনও আনাছ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১; সময়: ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ |
জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃষক বন্ধু ইউএনও আনাছ

নিজস্ব প্রতিবেদক : অনিয়ম করে পুকুর খনন করায় পুঠিয়া উপজেলার নিচু এলাকার কৃষি জমিতে জলাবদ্ধতা নিত্য দিনের চিত্র। এতে কৃষকরা চরম ভোগান্তিতে পড়লেও প্রভাবশালীদের দৌরাত্মের কারণে ভয়ে পানি অপসারণের ব্যবস্থা করতে পারতেন না। কৃষকদের এমন দুর্দশায় সহমর্মিতা ও অভিভাবক হিসেবে আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ। কৃষকদের সাথে উপস্থিত থেকে কোথাও আলোচনার মাধ্যমে আবার কোথাও আইন প্রয়োগ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। তার এ উদ্যোগে অভিভূত কৃষকরা বলছেন, ইউএনও পুঠিয়া শুধু একজন সরকারি কর্মকর্তা নয়, তিনি কৃষক বন্ধু ও অভিভাবক। কৃষকের স্বার্থই তার স্বার্থ।

সরেজমিন পুঠিয়ার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রায় এক যুগ ধরে আইনের তোয়াক্কা না করে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার নিচু এলাকার কৃষি জমিতে নির্বিচারে পুকুর খনন করার মহোৎসব চলছিল। বছর খানেক ধরে পুকুর খনন বন্ধ। কিন্তু পুকুরের বাঁধ থাকার কারণে পানি অপসারণ কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। এতে বছর জুড়েই আবাদি ফসলের জমি পানিতে তলিয়ে থাকতো। চাষ করা যেত না ফসল। প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনরা এসব পুকুরের মালিক হওয়ায় পানি কোনভাবেই বের করা সম্ভব হয়নি। এতে করে বছরে কোটি কোটি টাকার লোকশান হতো এই উপজেলার কৃষকদের।

স্থানীয় প্রশাসনের হিসেব ও কৃষকদের ভাষ্যমতে, পুঠিয়া উপজেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ৩৬ হাজার ৫৬৫ একর। এর মধ্যে গত কয়েক বছর উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি অফিসকে ম্যানেজ করে একটি মহল স্থানীয় চাষীদের প্রায় ১১ হাজার একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করেছে। অনিয়ম করে পুকুর খনন করায় গত কয়েক বছরে ফসল পানিতে তলিয়ে ব্যাপক লোকসানে পড়েছে চাষিরা।

সরেজমিন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে শিলমাড়িয়া ও ভালুকগাছি ইউনিয়ন এলাকায়। এখানকার কৃষকদের হিসেবে, পুকুর খনন করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার একর। এতে করে বর্ষা মৌসুমে দুই এলাকার পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বর্ষার শুরু থেকে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে করে কয়েক বছরে হাজার হাজার একর জমির ফসলহানি ঘটেছে।

বছরের পর বছর ফসল নষ্ট হলেও কৃষকরা প্রশাসন সহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। এ অবস্থায় সম্প্রতি তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট দ্বারস্থ হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরুল হাই মোহাস্মদ আনাছ বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে এ বছরের শুরু থেকেই জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ শুরু করেন। কথা হয় এই উপজেলার একাধিক কৃষকদের সাথে কৃষকরা জানিয়েছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ এর উদ্যোগে শিলমাড়িয়া ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭ কিলোমিটার খাল খনন ও পুনঃ খনন করা হয়েছে। যার ৯০ ভাগ জায়গা বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তি স্বেচ্ছায় জনকল্যাণে দান করেছেন।

সেখানকার সাধুরজলা ব্রিজ থেকে পচামাড়িয়া ব্রিজ পর্যন্ত খাল খনন করতে স্থানীয় আমজাদ হোসেন প্রায় ১০০ ফিট লম্বা জায়গা দান করেছেন। একই ইউনিয়নের পচামাড়িয়া ব্রিজ থেকে সামনের দিকে প্রায় ১০০ ফিট জমি দান করেছেন প্রয়াত গোলাম রসুল। ইউএনও’র উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে গোলাম রসুল জীবিত থাকাকালীন সময়ে খাল খননের জন্য জমি দান করেছিলেন। একইভাবে পচামাড়িয়া ব্রিজ থেকে প্রায় ১০০ ফিট লম্বা জায়গা দান করেছেন দেলোয়ার হোসেন।

একাধিক কৃষক জানিয়েছে, ইউএনও দিনের পর দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জলাবদ্ধতার সমাধান করে চলেছেন। এই উদ্যোগ মাইলফলক হয়ে থাকবে। শিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন মুকুল বলেন, অপরিকল্পিত ভাবে যেখানে সেখানে পুকুর খননের কারণে গত বছর এই এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছিল। বিষয়টি ইউএনও মহোদয়ের নজরে আনলে তাঁর উদ্যাগে এবার বর্ষার আগেই কয়েকটি বিল অতিক্রম করে প্রায় ৭ কিলোমিটার খাল-নালা খনন করা হয়েছে। যার ফলে ওই এলাকাগুলোতে এবার গতবারের মত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়নি।

বেলপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বদি বলেন, মাহেন্দ্রা এলাকায় প্রায় এক দশক ধরে পানি প্রবাহের খাল দখল করে একটি প্রভাবশালী মহল মাছ চাষ করছিল। এতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো খালের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছিলেন আশপাশের নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা। তবে এপ্রিলের শুরুতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ উদ্যোগী হয়ে খালটি দখল মুক্ত করেন। সেখানে খাল কেটে দেয়ায় এবার স্বস্তি ফিরেছে পানিবন্দি মানুষের মাঝে। কৃষকরাও এখন অনেক খুশি।

ভালুকগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাকবির হাসান বলেন, গত কয়েক বছরে এলাকার কিছু লোকজন পানি প্রবাহের খাল ভরাট করে দেয়। যার কারণে বিভিন্ন বিলের পানি বেড়ে নিন্মাঞ্চল ডুবে যায়। বিষয়টি স্থানীদের নিয়ে একাধিকবার বসেও কোনো সুরাহা হয়নি। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করা হলে তিনি নিজে স্থানীয় লোকজন সাথে নিয়ে খালটি দখলমুক্ত করে খনন কাজে অংশ নেন। এছাড়াও বাঁশবাড়িয়া এলাকায় একটি ড্রেন নতুন করে খনন করা হয়। এতে জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়েছে।

উপজেলা সদর এলাকার কামাল হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতার দূর্ভোগের বিষয়ে যে কেউ ইউএনও স্যারকে অবহিত করলে তিনি তা তাৎক্ষনিক নিরসনের চেষ্টা করেন। আমাদের পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যাক্তি মাটি ভরাট করে পানি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। ইউএনও সাহেবকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি তাৎক্ষনিক লোকজন নিয়ে ড্রেন খননে এগিয়ে আসেন।

কামাল আরো জানান, গত কয়েক সপ্তাহ আগে সদর ইউনিয়নের পীরগাছা এলাকায় নতুন ড্রেন খনন করা হয়। সেখানে শ্রমিকদের উৎসাহিত করতে ইউএনও নিজেই কোদাল নিয়ে ড্রেন খননে যোগ দেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামসুনাহার ভূইয়া বলেন, প্রতিবছর জলাবদ্ধতার কারণে নিচু এলাকার লোকজন দীর্ঘদিন পানিবন্দি থাকতো। অনেক চাষিদের ফসলহানি ঘটতো। সে সমস্যার সমাধানে এ বছর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদ্যোগী হন। তিনি উপজেলার শিলমাড়িয়ায় ৭ কিলোমিটার, ভালুকগাছি এলাকায় প্রায় দেড় কিলোমিটার, পুঠিয়া ইউনিয়নের পীরগাছা এলাকায় ৮০০ মিটার, বাশবাড়ি এলাকার প্রায় ২৫০ মিটার, পৗরসভার ২ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ১০০ মিটারসহ সবমিলিয়ে প্রায় ১২ কিলোমিটার নালা ও খাল খনন ও পুনঃ খনন করেন। এতে জলাবদ্ধতা নিরসন হওয়ায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার কৃষক ও সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, এই এলাকায় জলাবদ্ধতা একদিনে হয়নি। কিছু লোকজন নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করে হাজারো মানুষকে দুর্ভোগে ফেলছেন। আমরা ইতিমধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ শুরু করেছি। বর্তমানে সব এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা হয়তো করা যাবে না। তবে শুকনো মৌসুম শুরু হলে জনপ্রতিনিধি ও সচেতন নাগরিকদের সাথে নিয়ে আমরা উপজেলার আরো কয়েক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগ করবো, ইনশাআল্লাহ।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে