টানা লকডাউনে অর্থ সংকটে চারঘাটে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে স্কুল শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২১; সময়: ৬:৩৬ অপরাহ্ণ |
টানা লকডাউনে অর্থ সংকটে চারঘাটে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে স্কুল শিক্ষার্থীরা

নজরুল ইসলাম বাচ্চু, চারঘাট : রাজশাহীর চারঘাটে টানা লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে সম্পৃক্ত হচ্ছে। করোনা সংক্রামন বেড়ে যাওয়ায় গত মার্চ, ২০২০ সন থেকে সারা দেশের ন্যায় উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবে উপজেলার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ উপার্জনক্ষম সদস্যদের আয় কমে গেছে। ফলে এসকল শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীরা বই খাতার বদলে পরিবারকে আর্থিক সহযোগীতা করতে পারিবারিক চাপে অথবা স্ব-ইচ্ছায় কর্মসংস্থানের দিকে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ইহাছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চারঘাট মেরামতপুর গ্রামের মন্টু মিয়ার ছেলে শাওন। বয়স ৯ বছর, পিরোজপুর-১ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। ডায়বেটিকস জোনিত রোগে বাবা মন্টু মিয়া (৫০) আকষ্মিক অসুস্থ হলে পরিবারের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেয়ার জন্য মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবার ভ্যান চালাতে শুরু করেন। ভ্যান চালিয়ে দুশো থেকে তিনশো টাকা আয় হয় তা দিয়ে চলছে এই শিশুর সংসার। এ প্রসঙ্গে শাওনের মা পিঞ্জিরা বেগম বলেন বড় ছেলের আলাদা সংসার। আমি চাই শাওন পড়ালেখা করুক কিন্তু তার বাবা অসুস্থ হওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে ভ্যান চালাতে হচ্ছে।
উপজেলার আসকরপুর গ্রামের শাহিনের ছেলে সম্রাট (১৭), সরদহ সরকারী মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেনীর ছাত্র।

তার বাবা একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান। শাহিন বরাবরই তার পড়ালেখার খরচ টিউশনি করে বহন করতো। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাকে বাধ্য হয়ে তাকে স্থানীয় একটি ট্রাভেলস এর দোকানে চাকুরি স্বল্প বেতনে নিতে হয়েছে। উত্তর মেরামতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম ছাত্র ইউসুব আলীর ছেলে শাওন (১৪) ও মুংলি আবাসনের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্র বাবলুর ছেলে নয়ন(১০) চারঘাট বাজারে যথাক্রমে কসমেটিকস ও গার্মেন্টস এর দোকানে কাজ করে। এমনই ভাবে উপজেলার প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামের অনেক শিশু ও কিশোর ছাত্র-ছাত্রী যারা পরিবারকে অর্থনৈতিক সহযোগীতা করার উদ্দেশ্যে ঔষুধের দোকান, ইঞ্জিনিয়ারিং ওর্য়াকশপের লেবার, ইটভাটার লেবার, পাওয়ার টলির হেলপার, হোটেল বয় ইত্যাদিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে এসকল শিশু ও কিশোর ছাত্র-ছাত্রীরা শারিরিকভাবে দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি ধীরে ধীরে শিক্ষা থেকে ঝড়ে পড়ে যেতে পারে বলে জানান স্থানীয় স্কুল শিক্ষক সাইদুর রহমান।

সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজগুলোতে অনলাইন ক্লাশ নেয়ার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও এগুলো যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে জানান একজন মাধ্যমিক স্কুলের অভিভাবক করিম। তিনি বলেন উপজেলার অনেক স্কুল ও স্কুলের শিক্ষক রয়েছেন যারা ডিজাটাল সিষ্টেমে অনলাইন ক্লাশে অভ্যাস্ত নয়। পাশাপাশি উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র জনগোষ্ঠী হওয়ায় তাদের অভিভাবকদের কাছে স্মার্ট ফোন নাই। আয় কমে যাওয়ায় ইন্টারনেট ক্রয় করার সামর্থ্যও অনেক অভিভাবক হারিয়ে ফেলেছে।

ফলে কোন কোন স্কুলের অনলাইন ক্লাশ হলেও লজিস্টিক সাপোর্টের কারনে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাশের পাঠ কার্যক্রমে অংশগ্রহন করতে পারে না বলে জানান তিনি। বিকল্প না থাকায় শিক্ষা ব্যবস্থায় দিন দিন বৈষম্য বাড়ছে।

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সরকারের বিভিন্ন শহরের স্কুল ও কলেজগুলো ভার্চুয়াল অনলাইন শিক্ষার নির্দেশনা প্রদান করলেও উপজেলা ভিত্তিক গ্রাম অঞ্চলের স্কুল ও কলেজগুলোর ছাত্র-ছাত্রীরা এখনো এসকল সেবা থেকে বঞ্চিত। অধিকাংশ স্কুল কলেজগুলোতে কম্পিউটার, মাল্টিমিডিয়া থাকলেও এগুলো অপারেট করার জন্য দরকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষন। ব্যবহার না থাকায় এ সকল তথ্য প্রযুক্তির মেশিনগুলো নষ্ট হচ্ছে বলে জানান চারঘাট পদ্মা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গাজিবার রহমান।

সরদহ সরকারী মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী সেলেবাসভিত্তিক প্রতিটি বিষয়ের উপর অনলাইন ক্লাশ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে অনলাইন ক্লাশ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ক্লাশটি রেকর্র্ডেড হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রীদের কোনরুপ অংশগ্রহন থাকে না।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার রাহেদুল ইসলাম বলেন, করোনার কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শিক্ষা মন্ত্রালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সেলেবাস কমিয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সাথে সাথে যে সকল শিক্ষার্থী স্কুলে আসবে না তাদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য শিক্ষকদের দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হবে। বিশেষ ক্লাশের ব্যবস্থা করে দুর্বল শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নেয়া হবে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকরা ফোনে অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোজ খবর নিচ্ছেন এবং পড়াশোনার নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।

 

  • 66
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে