কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছেনা রাজশাহীর সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচার

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২১; সময়: ৭:৪০ অপরাহ্ণ |
কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছেনা রাজশাহীর সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচার

নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্তমানে খবরের কাগজের পাতা উল্টালে প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে অতি পরিচিত কিছু খবর। অমুক সীমান্তে ১০ জন চোরাকারবারী গ্রেফতার, অমুক সীমান্তে চার’শ টাকায় ফেন্সিডিল ও এক হাজার টাকায় হেরোইন পাওয়া যাচ্ছে, অমুক সীমান্তে ৫০ লাখ টাকার হিরোইন-সহ মহিলা চোরাকারবারী আটক, সীমান্ত এলাকায় বসছে মাদকের হাট, অমুক সীমান্তে গাঁজা ও অফিম চাষ হচ্ছে ইত্যাদি-ইত্যাদি। আমাদের প্রত্যাহিক জীবনে উক্ত খবর গুলো রোজ নামচার মত। অবশ্য আমরা এর সবই চোখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছি। এই মাদক প্রতিরোধে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষনা করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। ফলে ধ্বংস হচ্ছে যুব সমাজ।

চোরাচালান নিয়ে ইতিহাস ঘাটতে গেলে অনেক কথা উঠে আসে। পৃথিবীতে নগর সভ্যতার উন্মেষকাল থেকে চোরাচালান শুরু হয়। ইংল্যান্ড শহর স্থাপনের পর পরই সেখান থেকে ইউরোপীয় বনিকরা সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশ গুলোর সাথে এই অবৈধ ব্যবসা গড়ে তোলে। মজার বিষয় সেই চোরাচালানের উন্মেষ লগ্নে এই ব্যবসার একমাত্র পন্য ছিল মাদক। যেমন- আফিম, চারস, মারিজুয়েনা ফল থেকে সৃষ্ট মদ এইসব।

এখন এর সাথে যুক্ত হয়েছে নানা প্রকার সিগারেট, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ইত্যাদি। নগর সভ্যতার পত্তনের সাথে সাথে যেমন শুরু হয়েছিল এর প্রসার , তেমনি এর গতিরোধের জন্যও চলেছে নানা প্রচেষ্টা। এখন যে অব্যাহত নেই সে কথা বলবনা, তবে এর গতি প্রকৃতি পাল্টে যাওয়ার কারণে চোরাচালানীদের সাথে যুক্ত হয়েছে তথা কথিত গডফাদার, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারের সুযোগ সন্ধানী এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী।

চোরাচালান অতি পরিচিত একটি আধুনিক বাংলা শব্দ। যার আবিধানিক অর্থ এরকম-বৈধ সনদপত্র ছাড়া সরকারী কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে নিষিদ্ধ সামগ্রীর অবাধ আমদানী রপ্তানীকে চোরাচালান বলে। আর যারা এ পেশার সাথে জড়িত তাদেরকে চোরাচালানী বা চোরাকারবারী বলা হয়। চোরাচালান দেশে আজ একটা সংক্রামক ব্যাধির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বেশ কিছু প্রভাবশালী সহ মধ্যবৃত্ত ও অসংখ্য নিম্ন আয়ের লোকদের কাছে এই ব্যবসা একটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন তারা বিদেশ থেকে আনছে সিগারেট, মশলা, চিনি, শাড়ী, বেল্ড সহ, ফেন্সিডিল, মদ, গাজা, হেরোইন এবং আফিম এর মত মরণ নেশা। যা খেয়ে দেশের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক সম্প্রদায় ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে ।

অপর দিকে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে চালান দিচ্ছে দেশের অতি প্রয়োজনীয় ভোজ্য পন্য ও বহু বৈদেশিক মুদ্রার আমদানী করা যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সমাগ্রী। এতে সম্পদহীন হয়ে পড়ছে দেশ। এমন ও লক্ষ করা গেছে আমাদের দেশীয় বিজ্ঞানীরা উন্নত প্রযুক্তি খাটিয়ে যে সমস্ত ভোজ্য পন্য তৈরী করেছেন চোরাকারবারীরা বিবেক বর্জিত পাষন্ডের মত সেগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্য দেশে। ফলে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরেও দ্রব্যগুলির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় মতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

মাদক সেবন প্রসঙ্গে কিডনী-লিভার ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ১৪ বছর বয়স থেকে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত কিডনী ও ক্যান্সারে আক্রান্ত রুগীদের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন মাদকে আসক্তের স্বীকার । এদের শরীর কিডনী-সহ মানব দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিরবে ধ্বংস হচ্ছে এবং দ্রুত মরণ ব্যধিতে পরিণত হচ্ছে।

মাদক প্রসঙ্গে সমাজের সুধীজনদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, অন্যান্য অপরাধ গুলির মতো চোরাচালানের পিছনেও প্রধানত দুইটি কারণ আছে। একটি হলো ধন লিন্সপা আর অপর একটি হলো বেকার সমস্যা। ধন লিপ্সার দিক থেকে ল্ক্ষ্য করা গেছে,আমাদের দেশে কিছু স্বার্থপর টাকাওয়ালা কোটিপতি লোক আছে যারা কাল টাকার পাহাড় গড়ার নিমিত্তে দেশের স্বার্থকে তুচ্ছ মনে করে বিবেকহীনের মত চোরাচালানের চেয়েও বড় বড় অপরাধ করতে দিধাবোধ করছে না। তাদের ধারণা চোরাচালান দেশে প্রচলিত আর দু’একটা ব্যবসার মতো। তাই নিজের স্বার্থের জন্য কিছু অবুঝ সরল জনশক্তিকে তারা টাকার লোভ দেখিয়ে কুপথে টেনে নিজের কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

অপর সমস্যাটা হলো বেকার সমস্যা। স্বল্প শিক্ষিত কিংবা শিক্ষিতরা চাকুরীর জন্য অফিস আদালতে ধরনা দিয়ে নিরাশ হবার পর চোরাচালান কে একটি সহজ ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করছে। কেননা এই ব্যবসা করে রাতা-রাতি অনেকেই জিরো থেকে হিরো বনেছেন। আর এই বিষয়টি কাজ করছে চাকরি না পাওয়া বেকার যুবকদের মধ্যে।

আমরা এক সময় খবরের কাগজে দেখেছি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কর ফাকি দিয়ে সীমান্ত এলাকায় অল্প বয়সের ছেলেদের রাখাল সাজিয়ে গরু পাচার করে আনা হতো। তাছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর লোকদের দিয়ে নিষিদ্ধ শাড়ী পাচারের অজস্র উদাহরণ আছে। আর এগুলি সবই দিনের আলোতে হতো। এদিক থেকে রাতের দৃশ্য আরও মারাত্বক। কারণ রাতে আসতো আগ্নেয়াস্ত্র।

বর্তমানে বিজ্ঞান এগিয়েছে। মানুষের চিন্তাধারা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই সাথে চোরাচালানেরও তৈরী হয়েছে নতুন-নতুন পদ্ধতি ও কৌশল। আমরা মানুষ খুন করে লাশের ভিতর দিয়ে সোনা পাচারের গল্প শুনেছি। গত কয়েক বছর পুর্বেও মুখ দিয়ে গিলে মলদ্বার দিয়ে সোনা পাচার কালে ধরা পড়েছিল কয়েক জন চোরাচালানী। এছাড়া প্রতিদিন ব্যাগের নীচে, ক্যালকুলেটরের ভিতরে, মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগে ইত্যাকার নানা পদ্ধতিতে চোরাই জিনিস দেশে আসছে এবং যাচ্ছে।

বর্তমানে এসব গল্প আর শোনা যায় না। এখন খবরের পাতা উল্টোলেই চোখে পড়ে চোরাচালান ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট, পুলিশের ফেন্সিডিল বানিজ্য রুখবে কে ? থানার মাসিক আয় ২০ লাখ টাকা। তবে এ বিষয়ে সমাজের অভিজ্ঞ মহলরা পুলিশের চেয়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবিকে এখন সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বিজিবি চাইলে নদী পথ দিয়ে দেশের অভ্যান্তরে মাদক প্রবেশতো দুরের কথা একটি পাখিও উড়বে না। কিন্তু তারা সেটি করছেনা। মাঝে মধ্যে বিজিপি থানায় এসে কিছু মাদক মামলা দায়ের করলেও সেগুলোকে পরিত্যাক্ত হিসাবে মামলা দিচ্ছেন। তাদের মতে, গোপনে আসা মাদক দ্রব্যের ছোবলে পড়ে আজ হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের লক্ষ-লক্ষ কিশোর যুবক ও ছাত্র সমাজ এই কালনাগিনীর ছোবলে পড়ে তারা হারাচ্ছে কর্ম শক্তি আর দেশ হারাচ্ছে জনশক্তি।

যাই হোক আমাদের মনে রাখতে হবে সমস্যা আসবেই, আর তার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। আমাদের জাতীয় মাধ্যম গুলিকে ব্যবহার করতে হবে। সরকারই প্রচেষ্টায় সভা সমাবেশ, সেমিনার, মিছিল মিটিং ও পোষ্টারিং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে চোরাচালান আমাদের কি-কি ক্ষতি করে। টেলিভিশনের মত অত্যান্ত শক্তিশালী মাধ্যমকে এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে প্রতিটি বাড়িতে টিভির প্রভাব বেড়েছে।

এছাড়াও মাদক দ্রব্য ও চোরাচালানের উপরে ধারাবাহিক নাটক ও স্বল্প ধৈর্ঘ্য ছবি নির্মন করা যেতে পারে। তা দিয়ে ব্যবসাও হবে আবার উপকারও হবে। এক সময় গ্রামাঞ্চলে বাইসকোপ(ভিডিও) দেখানো হতো। বর্তমানে এটি আর তেমন একটা চোখে পড়েনা। সর্বশেষ মাধ্যমটি হচ্ছে শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে-মসজিদে এ বিষয়ে গুলো আলোক পাত করানো । এ ছাড়াও পত্র-পত্রিকা গুলোতে আরও বেশী বেশী করে চোরাচালান বিরোধী খবর ছাপাতে হবে। গ্রাম অঞ্চলে আনছার, ভিডিপি যে সমস্ত কর্মী আছে তাদেরকেও এ ব্যাপারে সক্রীয় ভূমিকা পালন করানো যেতে পারে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না । এই দেশ, মাটি, মানুষ সবই আমাদের নিজস্ব সম্পদ। একান্ত নিজের দেশ রক্ষার জন্য চোরাচালান বিরোধী কর্ম প্রয়াসে ঝাপিয়ে পড়ার সময় এখনই। কারণ আজকের প্রজন্ম আগামী দিনের ভবিষ্যত। আমাদের স্লোগান হবে : এদেশের একটা কিছু অবৈধ পথে অন্য দেশে যাবে না। অন্য দেশ থেকেও কর ফাঁকি দিয়ে এ দেশে প্রবেশ করবে না।

  • 30
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে