পেনশনের টাকায় পাঠাগার (ভিডিওসহ)

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২১; সময়: ১:১৩ অপরাহ্ণ |
পেনশনের টাকায় পাঠাগার (ভিডিওসহ)

নিজস্ব প্রতিবেদক : পেনশন সরকারি চাকরিজীবীদের শেষ অবলম্বন। জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময় পেশায় নিয়োজিত থাকার পর চাকরিজীবন শেষ করে মানুষ পেনশন পান। যে কারণে এই অর্থ নিয়ে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে।

অনেকে পেনশনের টাকা দিয়ে শেষ বয়সে নিশ্চিন্তে থাকবেন বলে বাড়ি বানান। অনেকে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য টাকা জমিয়ে রাখেন। অনেকে পূণ্য লাভের আশায় হজ করতে যান, অনেকে ভ্রমণও করে থাকেন। কিন্তু এর কোনোটিই করেননি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা (৬৬)। প্রচলিত স্রোতে তিনি গা ভাসিয়ে দেননি। বরং স্রোতের বিপরীতে চলেছেন। তিনি নিজের ভবিষ্যতের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। ভাবেননি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রচলিত চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে তিনি তার সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থের প্রায় পুরোটা দিয়ে তৈরি করেছেন পাঠাগার।

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা ১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে চাকরি শুরু করেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ ৪০ বছর তিনি সেখানে শ্রম দিয়েছেন। এরপর ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে অবসর নেন বছর দু’য়েক আগে। যে মানুষটি সারাদিনের সবটা সময় গ্রন্থাগারে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতেন হঠাৎ অবসর নেবার পর তিনি এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করেন।

চারপাশে সব থেকেও তার মনে হতো কী যেন একটা নেই। এক সময় তিনি অনুভব করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গ্রন্থাগারকে তিনি ভীষণভাবে অনুভব করছেন, যেটি তার কাছে নেই। যদিও তার বাড়িতে ছোট একটি পাঠাগার আগে থেকেই ছিল। মনে মনে এই পাঠাগারটিকে বড় করার জন্য একটা ছক এঁকে ফেলেন তিনি। তারপর যেমন ভাবা তেমন কাজ। হাতে থাকা পেনশনের টাকা দিয়ে তিনি পাঠাগারটিকে আরো সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেন তিনি।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনে পরম বন্ধু হলো বই। যে জাতি যত বেশি জ্ঞান আহরণ করবে সে জাতি তত বড় হয়। আর বই পড়ার জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা হলো পাঠাগার। আর যেহেতু আমি ৪০ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে চাকরি করেছি তাই এমন একটি লাইব্রেরি আমার স্বপ্ন ছিল। তাই আমার কষ্টার্জিত পেনশনের টাকা দিয়ে এই স্বপ্নপূরণ করতে চেয়েছি। অনেক মহৎ ব্যক্তি পাঠাগার নির্মাণ করেছেন, যুগে যুগে এসব ব্যক্তিকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এসব দেখেও পাঠাগার তৈরি করার আমার ইচ্ছে হয়।’

এরপর রাজশাহী শহরের শিরোইলে অবস্থিত দেওয়ান মঞ্জিলের চতুর্থ তলায় গড়ে তোলেন প্রাণের পাঠাগারটি। যদিও এর কাজ এখনো চলমানখুব শীঘ্র এটি সকালে জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবেও বলে জানান তিনি।

লাইব্রেরি তৈরির কাজে তাকে সবচেয়ে বেশি সাহস এবং সহযোগিতা করেছেন তার দুই ছেলে তানভীর অপু ও তারেক অণু। তারা দেশ-বিদেশের বহু অমূল্য বই সংগ্রহ করে দিয়েছেন। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার এই পাঠাগারে মূলত প্রকৃতি, ভ্রমণ, সাহিত্য, চিত্রকলা, ইতিহাস বিষয়ক বই রয়েছে। এছাড়া, রয়েছে নানা ভাষার বই। তবে ইংরেজি ও বাংলা ভাষার বই এখানকার সংগ্রহে বেশি রয়েছে। এর মধ্যেই ক্যাটালগ তৈরির কাজও চলছে। খুব শীঘ্রই সেটিও হয়ে যাবে।

পাঠাগারটি কোন ধরনের পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সে বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদা খাতুন জানান, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে প্রকৃতি ও ভ্রমণের বই নিয়ে যারা উৎসাহী, তারা বেশ কিছু বিরল কিছু বই এখানে পাবেন। তিনি পাঠাগার নিয়ে আরো গভীর পরিকল্পনার কথাও জানালেন। এই পাঠাগারটি তিনি শুধু বই পড়ার মাঝে আবদ্ধ রাখতে চান না। পাঠাগারে তিনি নিয়মিত আড্ডার জন্য জায়গা রেখেছেন। সেখানে পাখি, ভ্রমণ, পর্বতারোহণ, সিনেমা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত আড্ডা হবে। সেই সঙ্গে সিনেমা ও তথ্যচিত্র দেখানো হবে।

মাহমুদা খাতুন তার জীবনের সব উপার্জন এই পাঠাগারের পেছনে ব্যয় করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, একটি টাকাও বিফলে যাবে না। এক সময় এই পাঠাগারটির প্রতিটি কোণা পাঠকের পদচারণায় মুখরিত হবে। আর এখানে এসে সকালেই বই পড়ে কিছু না কিছু জ্ঞান আহরণ করবেন। নিজের অন্তরের দৃষ্টি বাড়িয়ে নেবেন। এভাবেই একদিন দেশ এগিয়ে যাবে। সেই দিন বেশি দূরে নয়।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে