রাজশাহীতে মেয়রের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২১, ২০২০; সময়: ৩:০৯ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে মেয়রের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজশাহীর কাঁকনহাট পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন আবদুল মজিদ। প্রশাসক ছিলেন দুই বছর। এ পর্যন্ত পৌরসভার তিনটি নির্বাচনের প্রত্যেকটিতেই জয়ী হয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি মেয়রের চেয়ারে রয়েছেন প্রায় দুই দশক ধরে।

নির্বাচিত তিনবারের মধ্যে একবার আওয়ামী লীগ ও দুইবার বিএনপির মনোনয়ন ও সমর্থনে মেয়র নির্বাচিত হন আব্দুল মজিদ। তবে গত বার আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র হলেও এবার নৌকার টিকিট পাননি তিনি। ফলে এবার তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

প্রায় দুই দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এই মেয়রের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছরে প্রায় ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অভিযোগও পড়েছে একাধিকবার। কিন্তু এসব অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে আবদুল মজিদের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর ভয়াবহ এই আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পৌরসভার প্যানেল মেয়র-২ আমিরুল ইসলাম ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম মোর্তজা শেখ দুদকে অভিযোগ দেন। এর আগের দিনই তারা লিখিত অভিযোগ দেন জেলা প্রশাসক বরাবর।

অভিযোগে বলা হয়েছে, আগে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পকে নতুন করে তালিকায় দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ৬৭ লাখ টাকা। এছাড়াও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কাঁকনহাট পৌরসভায় ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি প্রকল্পের কাজ না করেই তুলে নেয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা। বাকি ৯টি প্রকল্পের কাজেও হয়েছে পুকুর চুরি।

পৌরসভার প্রতিবেদনের ১০ নম্বরে থাকা ‘কাঁকনহাট-রাজশাহী সড়ক থেকে ইয়াকুব আলীর বাড়ি পর্যন্ত এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ’ প্রকল্পের শুরু দেখানো হয়েছে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর। ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪৬ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি শেষ দেখানো হয়েছে চলতি বছরের ২৩ মার্চ। অথচ, সরেজমিনে গিয়ে এই রাস্তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এখনও ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছেন স্থানীয়রা।

একইসঙ্গে কাজ শুরু দেখানো হয়েছে ‘ব্রাহ্মণগ্রাম জুমা মসজিদের টাইলস স্থাপন’ প্রকল্পের। ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৭১ টাকা ব্যয়ে এই কাজটিরও সমাপ্তি দেখানো হয়েছে চলতি বছরের ২০ মার্চ। কিন্ত এখনো টাইলসের ছোঁয়া পায়নি মসজিদটি।

‘কাঁকনহাট-গোদাগাড়ী সড়ক থেকে হুমায়ুন আহম্মেদের বাড়ি পর্যন্ত সোলিং রাস্তা নির্মাণকাজ’ শুরু দেখানো হয়েছে ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ। ৫৬ হাজার ২৭১ টাকা ব্যয়ে কাগজে-কলমে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে চলতি বছরের ২১ মার্চ। সরেজমিনে গিয়ে পাওয়া যায়নি রাস্তার অস্তিত্ব।

সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছর নির্বাচনের আগে মাপজোখ হয়েছিলো। মেয়রের দেখা পাওয়া তো দূরে থাক, গত ৫ বছরে পৌরসভার কেউ রাস্তা নির্মাণের জন্য আসেননি। একইভাবে চলতি বছরের ২৪ মার্চ শেষ দেখানো হয়েছে ‘সুন্দরপুর গ্রামের রাস্তা থেকে কল্লোলের উঠান পর্যন্ত সোলিং রাস্তার নির্মাণকাজ’। ৫০ হাজার ৫৫২ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু দেখানো হয় ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর। বাস্তবে অস্তিত্ব নেই এই রাস্তাটিরও।

এছাড়াও চলতি বছরের ১৬ আগস্ট এই ৪টি প্রকল্প পুনরায় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়। এই ৪টিসহ মোট ১৩টি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৬ টাকা। গত ৫ অক্টোবরে পুনরায় দেয়া হয়েছে কার্যাদেশ।

অভিযোগ উঠেছে, এই প্রকল্পগুলোর কাজ না করেই বিল পরিশোধ দেখিয়েছেন পৌর মেয়র আবদুল মজিদ। অন্য প্রকল্পগুলোর কাজেও নয়-ছয় হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কাঁকনহাট কেন্দ্রীয় গোরস্থানের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, প্লাস্টার ও রং করা হয়। এজন্য বিল পরিশোধ করা হয় ৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। একই প্রকল্প সমান ব্যয় ধরে বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরেও। প্রথমবার এই কাজের ক্রমিক নম্বর ছিল ১০। পরে সেটি দেখানো হয়েছে ৫ নম্বরে।

তবে, ২০১৯-২০ এ নয়, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সেলিম রেজা। পরের অর্থবছরে কাজ হয়নি বলেও স্বীকার করেছেন মেয়রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলর।

এভাবে একই কাজ বারবার বাস্তবায়ন দেখিয়ে কাঁকনহাট পৌরসভায় বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। পৌরসভার মেয়র আবদুল মজিদ ও সচিব রবিউল ইসলাম যোগসাজশ করে এই অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দুদকে দেয়া আলাদা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, মেয়র ১৫ বছরে ১০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর মধ্যে রাজস্ব খাত থেকে আত্মসাৎ করেছেন ৫ কোটি টাকা। এছাড়া সরকারি উন্নয়ন সহায়তা তহবিল থেকে ৫ কোটি, গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৩ কোটি, ইউজি/আইপি- ২ থেকে ৮ লাখ ও ইউজিআইপি-২ থেকে প্রায় ২ লাখ টাকা পকেটে পুরেছেন মেয়র আবদুল মজিদ।

অভিযোগকারী কাউন্সিলর গোলাম মর্তুজা শেখ জানান, আবদুল মজিদ ২০ বছর ধরে পৌরসভার মেয়র। আর তিনি ১৮ বছর ধরে কাউন্সিলর। পৌরসভায় এমন কোনো অনিয়ম নেই যে মেয়র করেননি।

তিনি বলেন, গত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে পৌরসভার বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এরপর ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আর কোনো কাজ হয়নি। আগের প্রকল্পগুলো ক্রমিক নম্বর বদলে বাস্তবায়ন দেখিয়ে আড়াই কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন মেয়র। তিন বছর আগে কাজ করেও বিল পাননি ঠিকাদাররা। বার বার বিভিন্ন দফতরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মেয়র আবদুল মজিদ দাবি করেন, পৌরসভার উন্নয়ন করেছেন বলেই বার বার পৌরবাসী তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু একটি পক্ষ তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই অপপ্রচারে লিপ্ত। তারাই বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিয়ে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছেন।

মেয়র আবদুল মজিদ বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন পৌরসভার প্রকৌশল দফতরের কাজ। একই প্রকল্প বার বার কীভাবে এলো, বিষয়টি বলতে পারবেন প্রকৌশলী। মেয়র হিসেবে তিনি কেবল তাদের সাজিয়ে দেয়া নথিপত্রে সই করেছেন বলে দাবি করেন আবদুল মজিদ। সূত্র- জাগোনিউজ

  • 585
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে