হঠাৎ ভাইরাল খুকি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২০; সময়: ৯:৫৮ অপরাহ্ণ |
হঠাৎ ভাইরাল খুকি

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীতে তিরিশ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করেন দিল আফরোজ খুকি। ষাটের কাছাকাছি বয়সেও তিনি এখন সংবাদপত্র বিক্রি করে চলেছেন। বিত্তশালী পরিবারে তার জন্ম বা একজন নারী হওয়া তার সংগ্রামের পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাজশাহী শহরের মানুষের কাছে অতি পরিচিত খুকি হঠাৎ করেই ভাইরাল হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এখন অনেকেই তার খোঁজ নিচ্ছেন।

খুকির সংগ্রামী জীবন নিয়ে ২০০৯ সালে প্রতিবেদন প্রচার করেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। তখন সেটি নিয়ে সাড়া পড়েনি। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করেই খুকির সেই প্রতিবেদনের ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর সরকারি অনেক কর্মকর্তা তার খোঁজ খবর নিয়েছেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম লোক পাঠিয়ে খুকির পাশে দাঁড়িয়েছেন। খুকির বাড়ি পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল। রাজশাহী নগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকও তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও খুকির পাশে দাঁড়ানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকায় তার বাড়ি। এজেন্টদের কাছ থেকে সংবাদপত্র সমগ্রহ করেন সকালেই। সারাদিন ধরে তিনি শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি করেন। মাইলের পর মাইল হাঁটেন। তার কাঁধে ঝুলে থাকে একটি কাপড়ের ব্যাগ, যাতে থাকে সংবাদপত্র।

১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার আত্মীয় স্বজন তাকে গৃহ ছাড়া করেন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতো তার জায়গা হয়নি তার। এরপর থেকেই কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পাগলী বলে তাকে কেউ আশ্রয়ও দেয়নি। এমনকি অনেকে মারধরও করে। তবুও কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা।

উচিত কথা বলার জন্য, নিজের জন্য মুক্ত জীবনে বেছে নেয়ার কারনে, অনেকে তাকে না বুঝেই ‘পাগলী’ বলে ডাকে, উপহাস করে, লাঞ্ছণা করে। তিনি দমে যান না। চলার পথে কারো অভাব দেখলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। যাদের তিনি সাহায্য করেন তারা বেশিরভাগই নারী। অনেককে নগদ অর্থ ধারও দেনও তিনি।

অনেক মেয়ের জন্য সেলাই মেশিন এবং তাদের স্বামীদের সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন এবং কোনও বৈষম্য না করে নিয়মিত এতিমখানা, মসজিদ এবং মন্দিরে দান করেছেন। তিনি বেশ কয়েকটি পরিবারকে গবাদি পশু কিনে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করেছেন।

দিল আফরোজ খুকি বলেন, আমি যাদের দান করেছি তাদের বেশিরভাগের নাম মনে নেই। আজকাল, আমি কোনও অভাবী ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে বেশি বেশি হাঁটতে পারি না,” তিনি বলেন।

খুকির ভাগ্নে শামস-উর রহমান রুমি জানান, খুকি সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দশম। আশির দশকে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশুনা করেছেন। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল এবং বিধবা হয়েছিলেন কম বয়সেই। তিনি তার স্বামীর মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। বিপর্যয় থেকে বাঁচতে দ্বিতীয় বিয়ে না করে স্বাবলম্বী হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন এবং এখন বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজশাহীর আঞ্চলিক ‘সাপ্তাহিক দুনিয়া’ পত্রিকা বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহমেদ শফি উদ্দিন সাপ্তাহিকের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন।

তিনি বলেন, খুকির বোনের স্বামী আবদুল আজিজ তাকে আহমেদ শফি উদ্দিনের কাছে নিয়ে যান, খুকির জন্য একটি চাকরীর অনুরোধ নিয়ে।

‘‘খুকির বয়স তখন কুড়ির ঘরে। তিনি লিখতে জানতেন না বলে আমি তাকে তখন চাকরি দিতে পারিনি। আমি রসিকতা করে তাদের বলেছিলাম যে আমি তার জন্য হকার হওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ খুঁজে পাচ্ছি না।’’

আহমেদ শফি বলেন, ‘‘কয়েকদিন পর, খুকি আমাদের অফিসে এসে হাজির। বেঁচে থাকার জন্য চাকরীটা তার দরকার বলে জোর করতে থাকলেন। তিনি ২০ কপি দিয়ে শুরু করে সপ্তাহে ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করতে সময় নেননি। আমরা তাকে স্বর্নপদক দিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে তিনি শহরের অন্যান্য স্থানীয় দৈনিক বিক্রি শুরু করেন।

‘‘তার ভাল আচরণ, সুন্দর করে কথা বলেন, নিয়মানুবর্তী এবং গ্রাহকরা তার কাছ থেকে কাগজ কেনা পছন্দ করতেন। সুন্দরী যুবতী হওয়ার কারণে তাকে বারবার রাস্তায় হয়রানি ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল। তবে তিনি থেমে যান নি, বলেন আহমেদ শফি উদ্দিন।

নগর সংবাদপত্র হকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামিউল করিম সুজন বলেন, ‘‘খুকি এখনো প্রতিদিন ৩০০ টিরও বেশি কপি খবরের কাগজ বিক্রি করেন। আগে আরো বেশি বিক্রি করতেন। ইন্টারনেটের অগ্রগতিতে এখন সংবাদপত্রের বিক্রি কমেছে।

‘‘তিনি নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনেন, কখনো বাকী রাখেন না। কারো কাছ থেকে সহায়তা নেন না, নেয়াটা অসম্মান বলে মনে করেন। বরং, তিনি যাদের প্রয়োজনে তাদের দান করেন,” তিনি বলেছেন।

স্থানীয়রা জানান, খুকির কিছু আত্মীয় তাকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করেছিল, তবে এলাকাবাসী তাকে কেবল এই বাড়ি পেতে সহায়তা করেছিল। কথা বলার সময় স্থানীয়রা এই বাড়ি দখলের চেষ্টা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে খুকির ভাগ্নে শামস-উর রহমান রুমি বলেন, খালার জন্য তাদের পরিবারের সদস্যরা বিব্রত। তিনি সহায়তা নেয়া পছন্দ করেন না এবং প্রতিবেশীরা দেখেন যে পরিবার তাকে সহায়তা করছে না। যখন তার সত্যিকারের প্রয়োজন হয় তখন পরিবারের সদস্যরাই তার যত্ন নেয়, প্রতিবেশীরা তখন আসেন না।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, খুকি তো আমাদের দেশের সংগ্রামী নারীদের মধ্যে একজন জ্বলন্ত উদাহরণ। আসলে অনেকে আমরা তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী মনে করি। কিন্তু সে মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। কারণ সে কারোর কাছে হাত পাতে না, কারোর কাছ থেকে ভিক্ষাও নেয় না। সে নিজেই ইনকাম করে চলে এবং তার পৈতৃক সম্পত্তির উপর লোভ নাই। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আমাকে বলা হয়েছে যে, খুকির দায় দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমরা যেন গ্রহণ করি।

  • 6.8K
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে