দখল ও দূষণের কবলে পদ্মা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২০; সময়: ৭:৩০ অপরাহ্ণ |
দখল ও দূষণের কবলে পদ্মা

নিজস্ব প্রতিবেদক : দখলে-দূষণের কবলে পড়ছে পদ্মা নদী। পদ্মা নদীতে শহরের শক্ত ও তরল দুই ধরনের বর্জ্যই মিশে প্রতিনিয়ত নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। এছাড়া শক্ত আর্বজনা ফেলে দখল করা হচ্ছে নদীর তীরও। শহর রক্ষা বাঁধও দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা স্থাপন করা হয়েছে।

নদী গবেষকরা বলছেন, নদী দূষণ বাড়তে থাকলে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু যে বসবাসের অযোগ্য হবে তাই না, পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার পদ্মা নদীতে পানি বাড়তে থাকলে দখলের কারণে শহর রক্ষা বাঁধ দুর্বল হয়ে শহর ডুবে যেতে পারে। এছাড়া নদীর নাব্যতা হারিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তনও হয়ে যেতে পারে।

গত এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার পদ্মা নদী সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সব এলাকার বাসাবাড়ি থেকে প্রতিদিনের গৃহস্থালি ময়লা-আর্বজনা পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে শহরের বুলনপুর, কেশবপুর, শ্রীরামপুর, কুমারপাড়া, সেখের চক, পঞ্চবটি, তালাইমারী ও শ্যামপুর এলাকা শহর রক্ষা বাঁধের পাশে নদীসংলগ্ন হওয়ায় বসবাড়ির গৃহস্থালি সব ময়লা-আর্বজনাই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়।

এছাড়া শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্নস্থানে বিশেষ করে পাঠানপাড়া, দরগfপাড়া, বড়কুঠি ও শ্রীরামপুরসহ শহর রক্ষা বাঁধের নানা স্থানে বিভিন্ন ধরনের রেঁস্তোরা গড়ে উঠায় সব ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন সরাসরি পদ্মা নদীতে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া শহরের পাঁচটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মা নদীতে পড়ে।

নদী পাড় সংলগ্ন এলাকায় গত মঙ্গলবার দুপুর ১২ টায় কুমারপাড়া পদ্মার পাড়সংলগ্ন নদীতে এক নারীকে ময়লা ফেলতে দেখে এই প্রতিবেদক জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন তার নাম রুনা। তিনি বলেন, আমরা এই মহল্লার সবাই বাসাবাড়ির ময়লা ডাস্টবিনে (পদ্মা নদী দেখিয়ে বলেন) ফেলি। আর রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া ময়লা সিটি করপোরেশনের ভ্যান এসে নিয়ে যায়।

কুমারপাড়ার সুবাসী দাশ বলেন, সিটি করপোরেশনের ভ্যান কোনোদিন আসে সন্ধ্যার দিকে, কোনোদিন আসে রাত আটটার পর, ভ্যান খুঁজেই পাওয়া যায় না। এছাড়া গলির ভেতরে ভ্যান না ঢুকায় বাসাবাড়ির সব ময়লা পদ্মানদীতে ফেলা হয়।

কেশবপুর পুলিশ লাইনের সামনের টি-বাঁধের ধারে পড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন। সেইসব বর্জ্য সব পদ্মা নদীতে পড়ে বলে জানালেন গোলাম রসুল। তিনি ১০ বছর ধরে বাঁধের ওপর পান বিড়ির দোকান করছেন।

তিনি জানান, মাস ছয়েক ধরে সিটি করপোরেশনের লোকজন আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছে না। আগে তবু পরিষ্কার করতো। এখন প্লাস্টিকের কাপ, বোতল ও পলিথিন ও কাগজের ঠোঙ্গা সব পদ্মা নদীতেই ফেলা হয়।

পদ্মা নদী সংলগ্ন বড়কুঠি, পাঠানপাড়া, দরগাড়া, শ্রীরামপুর, তালাইমারী এলাকায় রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠায় দেখা গেছে সেখানকার সব বর্জ্যই পদ্মা নদীতে ফেলা হয়। ভারতের গঙ্গা নদীই বাংলাদেশে পদ্মা নদী নামে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের গোয়ালন্দ পর্যন্ত গঙ্গার অন্তর্ভুক্ত।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড (ইউপিপিসিবি) গবেশণায় বলছে, ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদী দৃষণের মধ্যে দ্বিতীয় নাম্বারে রয়েছে। আর যমুনা নদী রয়েছে দূষণের পশ্চম নাম্বারে। গঙ্গা নদীর ধারে সহস্রাধিক শহর, শিল্প কারখানা, দর্শনার্থী ও তীর্থ স্থান অবস্থিত। তাদের বর্জ্য প্রতিনিয়ত পদ্মা নদীকে দূষণ করছে।

তবে ভারতের হিন্দু বেনারস ইউনিভার্সিটির মহামানা মালিভিয়া রিসার্চ সেন্টার ফর গঙ্গার চেয়ারপার্সন প্রফেসর ত্রিপাঠী বলেছেন, এই কোভিডের কারণে গঙ্গা দূষণ ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৩ থেকে ১০ শতাংশ, বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড হ্রাস পেয়েছে ৩.৮ থেকে ২.৮ শতাংশ, ব্যাক্টোরিয়াল অণুজীবের পরিমাণ প্রতি ১০০ মিলিমিটারে কমেছে ২২০০ থেকে ১৪০০ মিলিমিটার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান জানান, শহরের মধ্যে থেকে স্লুইচ গেটের মাধ্যমে যে তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে তার মধ্যে দরগাপাড়া এলাকায় তরল বর্জ্যের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বেশি পাওয়া গেছে। এসব বর্জ্যের ফলে পদ্মা নদীর পানি দূষণ বাড়ছে। এর ফলে পদ্মায় জলজ জীবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ইতিমধ্যে দেখা গেছে শহরের তরল বর্জ্য বারনই নদীতে পড়ে সেখান জলজ জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। মাছসহ জলজ প্রাণীর পরিমাণ বহুলাংশে কমে গেছে।

সেভ দ্য ন্যাচার অ্যান্ড লাইফের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদীর জন্য সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য ও পলিথিনের ব্যাগ। এসব নদীর পানির দূষণ বাড়াচ্ছে। পদ্মা নদীর জীবৈচিত্র্য কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা পলিথিনের ব্যবহার কমানোর আন্দোলন করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, আমি কয়েকবছর আগে পদ্মা নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের যে তরল বর্জ্য যাচ্ছে তা গবেষণা করে দেখেছি তাতে দূষণের মাত্রা ব্যাপক। আর এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

এছাড়া পানিতে প্লাস্টিক, পলিথিনের বর্জ্য ফেলার কারণেও ব্যাপক মাত্রায় দূষণ হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য অনেক কমে গেছে। আগে যেমন পদ্মা নদীতে শুশুক দেখা গেলেও এখন আর দেখা যায় না। মাছের পরিমাণও বহুলাংশে কমে গেছে। এছাড়া পদ্মা নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। কারণ গবেষণা দেখা গেছে, পদ্মা নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের ফলে কৃষি জমিতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

এইজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার দূষক পরিশোধনকারী প্ল্যান্ট থাকা উচিত যা রাজশাহীতে নেই। তবে শুধু রাজশাহী একাই যে পদ্মা নদীকে দূষণ করছে বিষয়টা এমন না। পদ্মা নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় থেকে শুরু করে পদ্মা নদীর দুই ধারে অসংখ্য শহর রয়েছে তারাও পদ্মা নদীকে ব্যাপক মাত্রায় দূষণ করছে।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, পাঁচটি স্লুইচ গেটের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য পদ্মা নদীতে পড়ে। তবে বর্ষাকালে পদ্মা নদীর পানি বেড়ে গেলে তখন গেট বন্ধ থাকে যাতে পদ্মার পানি শহরে প্রবেশ না করে।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুন বলেন, সিটি করপোরেশনের তীর সংলগ্ন এলাকায় ভ্যান যাওয়ার কথা। এখন ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সাথে কথা বলা জানতে হবে যে, ভ্যান সেসব এলাকায় পাঠায় কি না।

শহর রক্ষা বাঁধ দখল : রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় বুলনপুর থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ দখল করে নানা স্থায়ী স্থাপনা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া শহর রক্ষা বাঁধেও ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী স্থাপনাও স্থাপন করা হয়েছে। শক্ত বর্জ্য ফেলে নদী তীর দখলও করা হচ্ছে। এছাড়া পদ্মাতীর সংলগ্ন বাসিন্দারা বাসাবাড়ির আর্বজনা ফেলেও নদী তীর দখল করছে। এর ফলে শহর রক্ষা বাঁধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর শ্রীরামপুরে শহর রক্ষা বাঁধ ঘেঁষে পদ্মার বিশাল জমি দখল করে গড়ে তুলেছে সীমান্তে অবকাশ ও সীমান্তে নোঙর নামের দুইটি বড় স্থাপনা। সেখানে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করা হয়। এছাড়া একটি স্থায়ী কনফারেন্স সেন্টারও গড়ে তোলা হয়েছে।

পাঠানপাড়া শহর রক্ষা বাঁধ ঘেঁষে পদ্মা নদীর পাড়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে লালন শাহ পার্ক। তার একাংশ পাঠানপাড়া ও দরগাপাড়ার স্থানীয় লোকজন অস্থায়ী গরুর গোয়ালে পরিণত করেছেন। সেখানে গরু রেখে লালন পালন করেন। এছাড়া বড়কুঠি সংলগ্ন এলাকায় পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে ২০-২৫টি অস্থায়ী দোকানপাট।

এছাড়া শহর রক্ষা বাঁধের ওপর রয়েছে অস্থায়ী দোকানপাট ও আওয়ামী লীগে বেশ কয়েকটি দলীয় ওয়ার্ড কার্যালয়। কুমারপাড়া পদ্মার পাড়ে প্রতিদিন সিটি করপোরেশনের ভ্যান থেকে শক্ত ময়লা আবর্জনা ফেলে পাড় দখল করা হচ্ছে। অনেকে তাদের বাসাবাড়ির নিচে শক্তভাবে পদ্মা নদীর পাড় দখল করে নিচ্ছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, নদীতে সলিড কিংবা লিকুইড কোনো বর্জ্য ফেলা উচিত না। এটা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ লিকুইড বর্জ্য পানিতে মিশে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি । এর ফলে জলজ প্রাণী মারা যায়। আর সলিড বর্জ্য ফেলা হলে কিংবা নদীর পাড়ে বা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসতি গড়ে তোলা হলে তা নদীর পাড়কে দুর্বল করে দেয়। শহর রক্ষা বাঁধের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। রাজশাহীতে এমনিতে বাঁধের পাশে নদীসংলগ্ন এলাকায় বসতি রয়েছে যা শহর রক্ষা বাঁধের জন্য হুমকিস্বরূপ। এসব অবশ্যই সরিয়ে ফেলা উচিত।

গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধ ২২ মিটার উঁচু হলে বাঁধ থেকে দুই মিটার নিচে রয়েছে শহর। ফলে বাঁধকে রক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধকে রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।

রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, ব্রিটিশ আমলে যখন শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয় তখন জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এই জন্য বাঁধের পাশের জমি খাস জমি হিসেবে পরিগণিত হয়। খাস জমির মালিক জেলা প্রশাসক। বিজিবি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নিয়েই তাদের রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করছে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নজরুল ইসলাম জানান, শহর রক্ষা বাঁধের কোনো জমি কেউ লিজ নেয়নি। খাস খতিয়ান জমি হলেও কেউ কোনো অনুমতি বা লিজ নেয়নি। তবে শ্রীরামপুর টি-বাঁধ থেকে সিমলা পার্ক পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধের জায়গা নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। সেই মামলায় হাইকোর্ট একটি স্ট্যাটাস কো দিয়েছেন।

  • 2
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে