রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধেক মধ্যবিত্ত পরিবারের

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২০; সময়: ৪:১০ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের অর্ধেক মধ্যবিত্ত পরিবারের

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানা এলাকার এক কিশোর হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ হয় গত ৮ অক্টোবর। পরে পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকার মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে, ওই কিশোর কিডন্যাপের শিকার হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওই কিশোরের বাবা রাতে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশের সাহায্য নেয়।

পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারে, ওই কিশোর আশপাশেই আছে। অভিযান চালিয়ে পুলিশ কয়েকজনকে আটকও করে। দুইদিন পর ১০ অক্টোবর রাতে ওই কিশোর বাড়ি ফিরে। তার বাবা পরে জানতে পারেন কিডন্যাপের এই ঘটনা ছিলো নাটক। তার ছেলে ও বন্ধুরা টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যেই এটা ঘটিয়েছে। ঘটনাটি ঐ কিশোরের বাবা পুলিশকেও অবগত করেন। পরে পুলিশ ওই কিশোরের কয়েকজন বন্ধুকে আটক করে অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়।

এ ঘটনার মতো আরো অনেক ঘটনা রাজশাহী মহানগরে ঘটছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এসব ঘটনায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোরেরাও জড়িত। সম্প্রতি রাজপাড়া থানা এলাকায় কিশোর বয়সীদের দ্বারা এক দোকানীকে ছুরিকাঘাতে খুনের শিকারও হতে হয়েছে।

এদিকে পুলিশের কাছে বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন থানায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিপদগামী হওয়া বিষয়ে অভিযোগ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত তিন দিনে রাজশাহী মহানগরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২১৪ জনকে আটক করা হয়েছে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, কিছু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য পাড়া-মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তারা একসঙ্গে মাদক সেবন, নারীদের উত্ত্যক্ত করাসহ ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে।

এ ছাড়া তারা অপরাধ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে। এই গ্যাংয়ের বাইরেও অনেক কিশোর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশ সাঁড়াসি অভিযান শুরু করেছে। তবে আগে থেকে যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, শুধু তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে কিশোরদের জড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এই বিশেষ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

গত শুক্রবার থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত রাজশাহী মহানগরের ১২ থানা এলাকায় পুলিশ মোট ২১৪ জনকে আটক করে। এর মধ্যে প্রথম দুই দিন আটক করা হয়েছিল ৯৮ জনকে। এর মধ্যে মুচলেকায় ছাড়া পেয়েছিল ৬৬ জন। আর গত রোববার থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত আটক করা হয় ১১৬ জনকে। এদের মধ্যে ১১২ জনকে মুচলেকায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আটককৃতদের মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ, নিম্নবিত্ত ৪০ শতাংশ আর উচ্চবিত্ত ১০ শতাংশ রয়েছে। আর এদের ৫০ শতাংশই শিক্ষার্থী। এদের বয়স ১৪ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত। পুলিশ মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দিলেও তাদের নাম পরিচয় ও ছবি রেজিস্ট্রার করে রাখছে। পরবর্তীতে তারা এটা ফলোআপ করবে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিছু কিশোর। তারা পাড়া মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা একসাথে মাদক সেবন, পাড়া মহল্লায় নারীদের উত্ত্যাক্ত করা সহ ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় খুন ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটছে। কিশোর গ্যাং এর সদস্য অপরাধ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে এবং পরিকল্পনা করছে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার নগরীতে কিশোর অপরাধীদের ধরতে পুলিশের বিশেষ অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। গত তিন দিনে যারা আটক হয়েছে তাদের ৩৫ ভাগই আগে লেখাপড়া করলেও এখন করে না। ৫০ ভাগ এখনো ছাত্র। এদের মধ্যে উচ্চবিত্ত আছে ১০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৫০ ভাগ আর ৪০ ভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আটককৃতদের মধ্যে ৩৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ১০ ভাগ অনিয়মিত মাদক সেবনকারী। এরা প্রভাব বিস্তারের জন্য মারামারি, ছিনতাই, ইভটিজিং এর সাথে জড়িত।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, গত তিন দিন ধরে রাজশাহী মহানগরে কিশোরদের গ্যাং কালচার রোধে অভিযান চলছে। এরা মূলত মাদকাসক্ত, মেয়েদেরকে ইভটিজিং করে। বেশ কিছু অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিষয়ে বিভিন্ন থানায় অভিযোগও করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান চলছে।

যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাদের পরিবারকে ডেকে বুঝিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিভাবকদের তাদের প্রতি নজর রাখতে বলেছি। ইতোমধ্যে কিশোর গ্যাং এর বিষয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা উঠেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের অভিযান অব্যহত আছে। আগামীতে রাজশাহী মেট্রপলিটন এলাকাকে কিশোর গ্যাং মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছি।

পুলিশ কমিশনার বলেন, আমরা শুধু মুচলেকা দিয়েই ছেড়ে দিচ্ছি না। এটি তাদের পরিবারকে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের ডাটাবেজ করা হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের প্রতিটি থানায় পুলিশ সদস্যরাও তাদের নজরে রাখছেন। তারা আবারও কোন অপরাধের সাথে জড়িত হলে আমরা প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। এছাড়া আমরা যাদের আটক করেছি তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মাদক মামলাসহ ৪/৫ টি করে মামলাও আছে। তাদের আমরা আদালতের কাছে সোপর্দ করছি।

তিনি বলেন, আমরা যাদের আটক করছি তারা সব ধরণের পরিবারের সদস্য। কেউ নিম্নবিত্ত, কেউ মধ্য বিত্ত আবার অনেকেই আছে উচ্চবিত্ত পরিবারের। তারা মুলত বন্ধুদের সাথে মিশে বিপথগামী হচ্ছে। অভিভাবকদের প্রতি আমাদের বার্তা, ছেলে মেয়েদের দিকে নজর রাখার জন্য। তারা আমাদের দেশের সম্পদ, এই সম্পদ কোনভাবে যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে দেশ ও জাতি হিসেবে অনেক পিছিয়ে থাকবো। সূত্র- রাজশাহী সংবাদ

  • 160
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে