করোনার থাবায় রেশম শিল্পের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: আগস্ট ১৩, ২০২০; সময়: ১২:০৪ অপরাহ্ণ |
করোনার থাবায় রেশম শিল্পের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক :  অস্তিত্ব সংকটে রাজশাহীর রেশম শিল্প।বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে ধুঁকে ধুঁকে চলা এ শিল্পখাত আবার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।করোনা ভাইরাসের কারণে গত দুই মাসের লকডাউনে কোটি কোটি টাকার লোকসানে পড়েছে সিল্কের তৈরি পোশাকখাত।এখন সিল্কের তৈরি পোশাকের শো-রুম খোলা থাকলেও বেচাবিক্রি নেমে এসেছে অর্ধেকে।বেচাবিক্রি না থাকায় কারখানার উৎপাদনও কমে গেছে।অথচ সব জনবলকে বেতন দিতে গিয়ে হিমশিমে পড়তে হচ্ছে সিল্কের তৈরি পোশাক উৎপাদনকারীদের।

ব্যবসায়ীদের মতে, করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশে রেশম শিল্পে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো লোকসান হবে। তাই এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনাসহ রেশম শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া ধ্বংসপ্রায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার কোনো সম্ভাবনা নাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব কারখানায় পোশাক তৈরি ও বিপণন করছেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কারখানায় থানকাপড় তৈরি করলেও পোশাক তৈরি করে না। তারা থান কাপড় উৎপাদন করে দেশের বিভিন্নস্থানে তা বিক্রি করে।গত এক দশক আগেও রাজশাহী মহানগরীর সপুরা এলাকায় ১৫টির মতো প্রতিষ্ঠান নিজস্ব কারখানায় পোশাক তৈরি ও বিপণন করলেও এখন তা মাত্র চার পাঁচটিতে নেমে এসেছে।করোনা ভাইরাসের কারণে লকাউনের কারণে ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সিল্কের কাপড় কারখানা ও শো-রুম বন্ধ ছিলো। রোজার ঈদের আগে সীমিত পরিসরে খোলা হলেও বেচাবিক্রি তেমন হয়নি। ৩১ মে পর থেকে লকাউন তুলে দেওয়া হলে শো-রুম ও কারখানা চালু করা হয়েছে। তবে বেচাবিক্রি আর আগের মতো জমে উঠেনি।বেচাবিক্রি নেমে এসেছে অর্ধেকে। কারখানা খোলা থাকলেও বেচাবিক্রি না থাকায় উৎপাদন কমে এসেছে অর্ধেকে।

মহানগরীর সপুরা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৭৯ সাল থেকেই রেশমের তৈরি পোশাক উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। রেশমের সুতা তৈরি ও সেই সুতা থেকে কারখানায় পোশাক তৈরি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।তবে সেই সুতাতে তাদের পুরো চাহিদা না মেটায় চীন থেকে সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামাল আমদানি করতে হয়।

দেশে সরকারিভাবে লকডাউনের ঘোষণার পর, ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তাদের কারখানা ও শো-রুম বন্ধ ছিলো। ৩১ মার্চ লকডাউন তুলে নেওয়ার পর এখন শো-রুম ও কারখানা দুটোই চালু করা হয়েছে।

রাজশাহী সপুরা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক সাজ্জাদ আলী জানান, লকডাউনের সময় কারখানা ও শো-রুম বন্ধ থাকলেও লকডাউন তুলে নেওয়ার পর এখন দুটোই চালু করা হয়েছে।আগে সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শো-রুম ও দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কারখানা খোলা রাখলেও এখন শো-রুম সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়।আর কারখানা চালু রাখা হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
তিনি জানান, লকডাউনের সময় শো-রুম ও কারখানা বন্ধ থাকলেও তিনশো জন শ্রমিক-কর্মচারীকে নিয়মিত বেতন দিয়েছি। ঈদের বোনাস দিয়েছি। এখন কারখানা ও শো-রুম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে না পারলেও শ্রমিক-কর্মচারীদের পুরো বেতনই দিচ্ছি।বেচাবিক্রি চারভাগের এক ভাগে নেমে এলেও কাউকে ছাঁটাই করিনি। এসব করতে গিয়ে ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। শুধু লকাউনের দুই মাসে আমার তিন কোটি টাকার মতো লোকসান হয়েছে।এখন লোকসান গুণেই কারখানা ও শো-রুম চালু রাখতে হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, গত ১০ বছর ধরেই সিল্কের তৈরি কাপড় উৎপাদন ও বিপণনের সাথে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানই ধুঁকে ধুঁকে চলছিলো। অনেকে টিকতে না পেরে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন করোনাভাইরাস আবার তাদের নতুনভাবে অস্তিত্ব সংকেট ফেলে দিলো।

ঊষা সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম বলেন, পহেলা বৈশাখ ও দুই ঈদকে কেন্দ্র করেই আমাদের বেচাবিক্রি বেশি হয়। করোনা ভাইরাসের কারণে পহেলা বৈশাখে তো বিক্রিই করতে পারিনি। তখন কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর ঈদের প্রতিদিন যেখানে কয়েক লাখ টাকার বিক্রি হতো সেখানে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকারও বিক্রি হয়নি। অথচ কারখানা ও শো-রুম মিলে প্রায় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে প্রতি মাসেই বেতন দিচ্ছেন মালিক।করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় দুই কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরো জানান, ধনী ব্যক্তিরা মার্কেটে না আসায় বেচাবিক্রি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি।কতদিনে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে তা তো কেউ জানিনা। ততোদিনে এই শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে। বেচাবিক্রি না হলে কতদিন লোকসান দিয়ে চালানো যাবে?

রাজশাহীর সিল্কের অন্য শোরুমগুলোর চিত্রই এমনই। লোকসানে পড়ছে সব পোশাকখাতের শো-রুম।
প্রায় সব শোরুমগুলোর মালিকরা জানালেন, এই করোনা ভাইরাসে তাদের কোটি কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন।

ধুঁকছে সরকারি প্রতিষ্ঠানও :
বেসরকারিভাবে উৎপাদনকৃত সব প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই। ধুঁকে ধুঁকে চলছে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডও। এই প্রতিষ্ঠান লোকবল ও আর্থিক সংকটে ভুগছে।চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য পরিমাণ সুতা ও কাপড় উৎপাদন করে থাকে তারা।বরং বেসরকারিভাবে উৎপাদনকৃত সিল্কের পোশাকই বাংলাদেশের সিল্কের তৈরি কাপড়ের চাহিদা মেটায়। প্রতিষ্ঠানটির বড় কারখানা থাকলেও শুধুমাত্র লোকবল ও আর্থিক সঙ্গতির অভাবে কারখানা পুরোদমে সচল করতে পারছে না।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সারাদেশে বিদ্যমান ১২টি মিনিফিলেচার থেকে প্রাপ্ত সুতা দিয়ে রাজশাহীর রেশম কারখানায় থান কাপড় তৈরি করা হয়। সেইসব কাপড়ও আবার ডাইং, প্রিন্ট করে শাড়ি, টাই, ডো-পিয়ন, বলাকা থান কাপড়, রঙিন বলাকা থান কাপড়সহ বিভিন্ন কাপড় তৈরি করে রেশম উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব শো-রুম রেখে বিক্রি করা হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রাজশাহীর রেশম কারখানার ৩৮টি লুম মেরামত করে সচল করা হয়েছে।পর্যায়ক্রমে সবসময় ৬টি লুম চালু রাখা হয়। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১২ টি মিনিফিলেচার থেকে প্রাপ্ত সুতা দিয়ে ৪ হাজার ৭৭০ মিটার কাপড় উৎপাদন করা হয়েছে।লকাউনের মধ্যে এপ্রিল মাস কারখানা বন্ধ থাকলেও গত জুলাই মাসে ৪০০ মিটার কাপড় উৎপাদন করা হয়েছে।

রাজশাহীর রেশম কারখানার ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ জানান, সারাদেশের ১২ টি মিনিফিলেচার থেকে প্রাপ্ত সব সুতা দিয়েই রাজশাহীর রেশম কারখানায় কাপড় তৈরি করা হয়। এই কাপড় দিয়ে শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় তৈরি রেশম উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব শো-রুমে রেখে তা বিক্রি করা হয়।

বাংলাদেশ রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী জানান, রেশম শিল্প দুইভাবে কাজ করে। এক হচ্ছে পলু পোকা থেকে সুতা উৎপাদন এবং দুই নম্বর হচ্ছে তার সুতা থেকে বস্ত্র তৈরি। রেশম শিল্পের সাথে শুধু রাজশাহী অঞ্চলে ৪০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী যুক্ত রয়েছে। সারাদেশে এক লাখের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী হবে। সারাদেশে বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সিল্কের তৈরি পোশাক উৎপাদন ও বিপণনের সাথে জড়িত। এছাড়া গুটি থেকে সুতা উৎপাদনের সাথে যুক্ত রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিক।করোনা ভাইরাসের কারণে রেশম শিল্পের সাথে জড়িত এইসব শ্রমিকও কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে।বেচাবিক্রি এভাবেই কমতে থাকলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে।

তিনি জানান, আমরা হিসেবে করে দেখেছি, করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশে রেশম শিল্পে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো লোকসান হবে। তাই এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনাসহ রেশম শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া ধ্বংসপ্রায় এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার কোনো সম্ভাবনা নাই।

  • 50
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে