রাজশাহী ও পাবনায় জমে উঠেছে আম-লিচুর বেচাকেনা

প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২০; সময়: ২:২০ অপরাহ্ণ |
রাজশাহী ও পাবনায় জমে উঠেছে আম-লিচুর বেচাকেনা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী : রাজশাহী ও পাবনার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এবছর আম ও লিচুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চাষীদের মতে গাছ থেকে অর্ধেক আম ও লিচু ঝরে গেলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে রাজশাহীতে ঝড়ে ১৫ শতাংশ আম ও লিচু এবং পাবনায় ২২ শতাংশ লিচু ঝরে গেছে। সেই ক্ষতি নিয়েই রাজশাহীর ৮৬ হাজার চাষী ও ব্যবসায়ীরা আম ও লিচু বাজারে তুলছেন। রাজশাহীতে লিচু বিক্রি শেষের দিকে। পাবনায় বিক্রি চলছে পুরোদমে। তবে দাম কম থাকায় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে চাষীদের।

রাজশাহীতে একটি দুইটি জাতের আম বিক্রি শেষের দিকে হলেও আরও মাসখানেক বাজারে পাওয়া যাবে বিভিন্ন জাতের আম। বলা যায়, রাজশাহীতে জমে উঠেছে আমের বেচাকেনা। চাষীরাও চাইছেন, ভালো দামে আম বিক্রি করে আম্পানের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে। সরকারিভাবেও আমচাষীদের সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চালু করা হয়েছে স্বল্প ভাড়ায় স্পেশাল ম্যাঙ্গো ট্রেন সার্ভিস ও নিখরচায় ট্রাক সার্ভিস। যাতে করে চাষীরা অল্প খরচে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আম বিক্রি করে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে।

রাজশাহীর বানেশ্বর হাট দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম আম বেচাকেনার মোকাম। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এই হাটে এসে আম কেনেন। আম কিনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা হয়। এছাড়া রাজশাহীর শহরের বিভিন্ন পয়েন্টেও আম বেচাকেনা হচ্ছে। প্রচুর আম বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে অর্ডারের মাধ্যমেও।

বানেশ্বর বাজার ঘুরে এবং আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা দেখা গেছে, বাজারে গোপালভোগ জাতের আম শেষের দিকে। বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে লখনা ও গুটি আম। অল্প পরিমাণে উঠতে শুরু হয়েছে হিমসাগর ও ল্যাংড়া।

আমচাষীরা বলছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে ল্যাংড়া ও হিমসাগর আম পুরোদমে বাজারে বিক্রি হবে। বাজারে মানভেদে গোপালভোগ আম বিক্রি হয়েছে দুই হাজার টাকা থেকে ২৪০০ টাকা মণ হিসেবে। মানভেদে লখনা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা মণ, হিমসাগর বা খিরসাপাত ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা,ল্যাংড়া ১৬০০ টাকা এবং গুটি আম ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ হিসেবে।

রাজশাহীর কাটাখালীর আম ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবছর আমের দাম গতবছরের চেয়ে ভালো। ফলন কম হলেও দাম ভালো থাকায় চাষীরা লাভবান হবেন। এবছর আম ঝরে গেলেও গোপালভোগ আমের ফলন ভালো হয়েছে। দামও ভালো পাওয়া গেছে। বুধবার ২০ মণ গোপালভোগ আম বিক্রি করেছি ২১০০ টাকা মণ হিসেবে। গুটি আম ও লখনা আমের দামও ভালো। হিমসাগর, ল্যাংড়া আম পরিপক্ক হতে আরো সপ্তাহখানেক লাগবে। তখন আমের দাম ভালো পাওয়া যাবে।

তবে রাজশাহীর আড়ানীর আমচাষী আলতাফ হোসেন বাদশা বলেন, এবছর আম বিক্রি করে লোকসানে রয়েছি। এখন পর্যন্ত এক হাজার মণ আম বিক্রি করে এক লাখ টাকা লোকসান রয়েছি। আমের চাহিদা কম থাকায় লোকসান হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রতিবছর আমের মৌসুমে আমি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় প্রতিদিন এক ট্রাক করে আম দিতাম। এখন সেখানে তিন/চার দিন পর এক ট্রাক করে আম যাচ্ছে। এখন লখনা ও হিমসাগরের দাম কিছুটা কম আছে। তবে আশা করছি, সপ্তাহখানেকের মধ্যে পুরোদমে বাজারে উঠলে এসব আমের দামও ভালো পাওয়া যাবে।

লিচু চাষীরাও বলছেন, দাম ভালো থাকলেও ফলন কম হওয়ায় লোকসানে গুণতে হচ্ছে।

রাজশাহীর বড় বনগ্রাম এলাকার লিচু চাষী আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমার ২০ বিঘা লিজ নেওয়া ও নিজস্ব ১৫ বিঘা জমিতে লিচু চাষ করেছিলাম। এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানে অর্ধেক লিচুই ঝরে গেছে। আমাদের এলাকায় ৫ থেকে ৬ কোটি পিস লিচু উৎপাদন হয়। এবার আম্পানে তার অর্ধেক লিচুই ঝরে গেছে। ফলে দাম ভালো পেলেও ফলন কম হওয়ায় লোকসান গুণতে হয়েছে। আমাদের সব লিচু ঢাকায় হাজারে ১৮০০ টাকা থেকে ২৩০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামসুল হক জানান, রাজশাহীতে এবছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ১৫ শতাংশ আম ঝরে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ১১০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এবছর আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। তবে গাছে আম সংখ্যায় কম থাকলে আমের আকার বড় হয়। তখন আমের ওজনও বেশি হয়। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও কাছাকাছি যাবে। এছাড়া দাম ভালো থাকায় চাষীদের খুব একটা লোকসান হবে না। এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আম গাছ থেকে পাড়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, গোপালভোগ আম শেষের দিকে। হয়তোবা বাজারে ৩/৪ দিন আর পাওয়া যেতে পারে। এখন বাজারে অল্প পরিমাণে উঠতে শুরু করেছে খিরসাপাত, হিমসাগর ও লখনা।

তিনি বলেন, রাজশাহীতে মোট ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদন হয়। এবছর রাজশাহীতে লক্ষণভোগ বা লখনা ৬২৭১ হেক্টর, খিরসাপাত ২৬১৭ হেক্টর, ফজলি ২২৬৬ হেক্টর, আশ্বিনা ১৬৭৬ হেক্টর, আম্রপালি ১০৫০ হেক্টর, গোপালভোগ ৫৯৪ হেক্টর এবং বাকিগুলো গুটি আমসহ অন্যান্য জাতের আম উৎপাদন হয়।

লিচুর বিষয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে মোট ৫০০ হেক্টর জমিতে লিচু উৎপাদিত হয়। এক একটি লিচু প্রতি উৎপাদন খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৭০ পয়সা। সে হিসেবে বাজারে লিচু দুইশো থেকে ২৪০ টাকা শো হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। তার মানে চাষীদের লাভই হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীর সপ্তাহখানেক পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম ওঠা শুরু হয়। সেহিসবে আর দুই চারদিন লাগবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাজারে উঠতে। এবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ফলন ভালো হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমের দামও ভালো আছে। আশা করছি কৃষকরা এবছর আম বিক্রি করে লাভবান হবেন। আগামি ১৩ জুন থেকে ডাকবিভাগের ট্রাকে করে বিনা ভাড়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ঢাকায় যাবে। এছাড়া শুক্রবার থেকে স্পেশাল ম্যাঙ্গো ট্রেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ঢাকায় পৌঁছানো হবে।

এদিকে সরকারিভাবেও আমচাষীদের সহায়তা করতে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে শুক্রবার বিকেল থেকে চালু হয়েছে স্পেশাল ম্যাঙ্গো ট্রেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কেজিপ্রতি এক টাকা ৩০ পয়সা আর রাজশাহী থেকে কেজিপ্রতি এক টাকা ১৭ পয়সা দরে আমব্যবসায়ী ও চাষীরা প্রতিদিন ২৪০ মেট্রিক টন আম ঢাকায় পৌঁছাতে পারবেন।

এছাড়া গত মঙ্গলবার(২ জুন) থেকে ডাক বিভাগের একটি ট্রাকে করে সর্বোচ্চ ৫ মেট্রিক টন আম প্রতিদিন বিনা ভাড়ায় ঢাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক আমচাষীরা।

পশ্চিমাঞ্চল রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ফুয়াদ হোসেন বলেন, স্পেশাল ম্যাঙ্গো ট্রেনের ছয়টি ওয়াগনে সর্বোচ্চ ২৪০ মেট্রিক টন আম বুকিং করা যাবে। প্রথমদিনে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১০ টন ১৫ কেজি আম বুকিং হয়েছে। প্রথম প্রথম দেখে এখনো সেইভাবে আমরা চাষীদের সাড়া পায়নি। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন হাটে গিয়ে চাষীদের সাথে কথা বলে প্রচার-প্রচারণা চালাতে। এছাড়া ব্যানার ফেস্টুনও করা হয়েছে। আশা করছি দুই একদিনের মধ্যে কৃষকদের ভালো সাড়া পাবো।

তিনি বলেন, ট্রেনে ভাড়া তো কম নেওয়া হচ্ছে। আবার ক্যারেট প্রতি কুলিদের ফিও ২৭ টাকা থেকে কমিয়ে ১০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক বলেন, বিনা ভাড়ায় ট্রাকে আম পরিবহনের মূল উদ্দেশ্য সরাসরি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা করা। প্রতিদিন ট্রাকে আম যাচ্ছে। চেষ্টা করছি ট্রাক সংখ্যা বাড়াতে।

পাবনা প্রতিনিধি জানান, পাবনায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানে পাবনায় কৃষকদের মতে দেড়শো কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ২২ শতাংশ লিচু গাছ থেকে ঝরে গেছে।

পাবানার বাজারে লিচু খুচরা বিক্রি হচ্ছে, ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকা শো দরে। আর হাজার বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকা দরে।

পাবনার বাঁশেরবাদা লিচু ব্যবসায়ী মো. শিপন আহমেদ জানান, এবছর গাছে যে পরিমাণ লিচু ধরেছিলো তাতে পাবনায় এবার লিচুর বাম্পার ফলন হতো। কিন্তু আমপানের তান্ডবে বাাগানের অর্ধেক লিচু ঝরে গেছে। ফলে বাজারে গতবছরের দামে লিচু বিক্রি হলেও আমাদের লোকসানটা থেকেই যাচ্ছে। দাম বেশি হলে সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হতো।

পাকশী গ্রামের লিচু বাগান মালিক রাসেল হোসেন বলেন, লাভের আশায় ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়ে ১০টি বাগান কিনেছিলাম। কিন্তু আমপানের তাণ্ডবে এবার লিচুর বাগানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমার প্রায় ৫০ লাখ টাকার লিচুর ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া আমাদের এলাকাসহ আশেপাশের আওতাপাড়া, দাপুনিয়া, আটঘোড়িয়া, একদন্ত গ্রামের সব বাগান মিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক মো. আজহার আলী বলেন, পাবনা জেলার মাঠে ধান আম-লিচু ও সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাবনায় চলতি মৌসুমে ৪৬০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে । সাইক্লোন আমপানের তান্ডবে প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ হেক্টর লিচু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখনও ক্ষতির সঠিক পরিমান নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

  • 171
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে