সুপারিশ বন্ধ না হলে আ.লীগে বিতর্কিতদের সংখ্যা বাড়বেই

প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০২১; সময়: ১১:১০ অপরাহ্ণ |
সুপারিশ বন্ধ না হলে আ.লীগে বিতর্কিতদের সংখ্যা বাড়বেই

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে গত একযুগ ধরেই চলছে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে আসার বিতর্ক। দলের মধ্যে জেঁকে বসা এমন নেতারা একেকজন একেকটা বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন।

আর সেই বিতর্কের আলোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাপিয়ে গণমাধ্যমে চলে আসার পর তড়িঘড়ি করে অব্যাহতি কিংবা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি ‘সামলাতে’ হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। কিন্তু এমন ব্যক্তিদের দলে প্রবেশ রোধে স্থায়ী কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে ফাঁকফোকর দিয়ে এ ধরনের অনুপ্রবেশ চলতেই থাকে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতারা বলছেন, অনুপ্রবেশকারী কিংবা বিতর্কিতরা দল ও দলের সহযোগী সংগঠনে পদ পাওয়ার একমাত্র কারণ ‘সুপারিশ’। দলের প্রভাবশালী নেতাদের এই সুপারিশ করা বন্ধ করতে হবে। প্রভাবশালী নেতারা না জেনে, না বুঝে কারও জন্য সুপারিশ করা বন্ধ না করলে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে ঢুকবেই। এটা কোনওভাবেই থামানো যাবে না।

আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের অনেকের অভিযোগ, বর্তমানের রাজনীতিতে দলের চেয়ে ব্যক্তিগত শক্তি কীভাবে বাড়ানো যায়- সবার মধ্যে সেই প্রতিযোগিতা থাকে। আর এই প্রতিযোগিতার কারণেই আওয়ামী লীগে বিতর্কিতরা ঢুকে পড়ার সহজ সুযোগ পায়।

দলটির নেতারা বলছেন, আগে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কারও সুপারিশে আমরা কাউকে নেতা ‘বানাবো’ নাকি ‘বানাবো না’। সুপারিশে নেতা বানালে দলে বিতর্কিতরা জায়গা পাবেই। ঠেকানো যাবে না তা। রাজনীতিতে বাধার সম্মুখীন হবেন দলের আদর্শিক ও ত্যাগী নেতারা। যদি ‘সুপারিশে নেতা বানাবো না’- এই সিদ্ধান্ত সংগঠনের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় অনুপ্রবেশকারী বা বিতর্কিতরা দলে ঢোকার কোনও সুযোগই আর পাবে না।

আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বীকার করেন, দলে ঢুকে যারা সরকারের ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে তাদের অধিকাংশই নেতাদের কারও না কারও সুপারিশে আওয়ামী লীগে পদ পেয়েছেন। এমনকি করোনা মহামারিকালে করোনার ভুয়া পরীক্ষা করে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত শাহেদও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশেই।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, রাজনীতিতে একটা ‘ব্যাড প্র্যাকটিস’ চালু হয়েছে, দলের চেয়ে ব্যক্তির শক্তি কীভাবে বাড়ানো সম্ভব। এমপি হলে তিনি চান ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে। তাই তার জনবল লাগবে। নেতা হলে তিনিও চান তার পকেটের লোক দরকার। এই দরকারের অশুভ প্রতিযোগিতায় বিতর্কিতরা সুযোগ পেয়ে যান আওয়ামী লীগে প্রবেশের। শুধু তাই নয়, এসব বিতর্কিতরাই কোনও না কোনও অপচেষ্টায় বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিও হয়ে যাচ্ছেন। তাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকে করে তোলে বিব্রত।

তিনি বলেন, উপর থেকে চাপিয়ে দিয়েও নেতা বানানোর সংস্কৃতি ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রকে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বিতর্কিতদের দলে ঢুকে পড়ার সুযোগ থেকেই যাবে।

সম্প্রতি ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে হঠাৎ বিতর্কের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসা আলোচিত-সমালোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর। তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটিতে সদস্যও। সমালোচনার মুখে পড়ে অবশ্য সদ্য উপকমিটির সদস্য পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তার পদ পাওয়ার পেছনেও অন্যতম কারণ সুপারিশ।

আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকী গত রোববার বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর মহিলা বিষয়ক উপকমিটিতে সদস্য পদ পেয়েছেন আমাদের দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার সুপারিশে। ওই উপকমিটির সদস্য সচিব চুমকীর দাবি, হেলেনা জাহাঙ্গীরের জন্য আমার কাছে নেতাদের সুপারিশের রেকর্ড রয়েছে।

এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য পদে স্থান পেয়েছেন জারা মাহাবুব। তার বাবা কাইয়ুম রেজা চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাফাই সাক্ষী ছিলেন। জারা মাহাবুব পদ পাওয়ায় সমালেচনার ঝড় উঠেছে সারাদেশে।

উনি কীভাবে জেলার সদস্য পদ পেয়েছেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, আমাদের দলের সভাপতিমণ্ডলির এক সদস্যের সুপারিশে পদ দিতে হয়েছে জারা মাহাবুবকে। এস এম কামাল সভাপতিমণ্ডলির ওই সদস্যের নাম বলতে রাজি হননি। ওই জেলায় হাবিবুর রহমান মজনু পদ পয়েছেন সুপারিশে। মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রবিন হাসান রকিকে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর কিছু দিন আগে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান রনিকে পৌর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।

ছাত্রলীগের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালী দুই জন নেতার সুপারিশে দুই জনকে নেতা বানাতে বাধ্য হয়েছি।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে নেতার তালিকাটা আরও অনেক দীর্ঘ। আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, সুপারিশে নেতা হওয়ার সংখ্যা আওয়ামী লীগে বেড়েই চলেছে। ব্যক্তিগত বলয় গড়ে তুলতে যাচাই-বাছাই ছাড়া সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে আওয়ামী লীগে পদ পেয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। পরে তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকারের ও দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

তিনি বলেন, পদ দিতে আমাদের সবাইকে সবাইকে সচেতন হতে হবে। যাকে পদ দিচ্ছি বা যার জন্য সুপারিশ করছি- ওই ব্যক্তি দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ; সেই বিবেচনাবোধ থাকলে পরে ওই ব্যক্তিকে অব্যাহতি বা বহিষ্কার করার দরকার পড়ে না।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, প্রত্যেক সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারী কোনও না কোনও নেতার সুপারিশেই পদ পাচ্ছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই সহজ, সরল ও গণমুখী। ফলে চতুর ব্যক্তিরা টার্গেট নিয়ে কারও না কারও আস্থা অর্জন করে সুপারিশ করাচ্ছেন, আমরাও করছি।

স্বপন বলেন, আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আদর্শিক রাজনীতির চর্চার পরিবর্তে ‘ভাই লীগ’-এর উত্থানের ফলে রাজনীতিতে আবর্জনা জায়গা দখল করছে। এখনই সাবধান না হলে আরও ভয়াবহ পরিণতি হবে বলেও সতর্ক করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এই নেতা।

  • 27
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে