প্রতিটি দিনই হোক মা দিবস

প্রকাশিত: মে ৯, ২০২১; সময়: ৫:৩৪ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
প্রতিটি দিনই হোক মা দিবস

সালেক উদ্দিন : আজ এ বছরের বিশ্ব মা দিবস। ‘এ বছরের’ বললাম এই কারণে যে দিবসটি সৌরবর্ষ ক্যালেন্ডারের নির্ধারিত কোনও তারিখ নয়। মে মাসে দ্বিতীয় রবিবার পালন করা হয় বিশ্ব মা দিবস। প্রতিবছর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই মা দিবস পালিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রাচীন গ্রীসে মা দিবসের পালনের প্রচলন থাকলেও এর ব্যাপক বিস্তৃতি হয় বিশের দশকে।

১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আনাজার্ভিস নামে এক নারীর মৃত্যু হলে তার কন্যা আনা মারিয়া রিভস জার্ভিস তার মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখতে সানডে স্কুলে প্রথম এই দিনটি মা দিবস হিসাবে পালন করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকেই আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন দেশে মা দিবস পালনের প্রচলন রয়েছে।

এই দিনে সন্তানরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাকে নিয়ে সময় কাটায়। কেক কেটে উপহার দিয়ে মাকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এটি এক ধরনের কৃত্রিমতা তারপরও এই দিবসটি যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে এই কারণেই যে মায়ের তুলনা শুধু যে মা’ই হয়-এই কথাটি পৃথিবীর সব সন্তানদের অন্তত একদিনের জন্য হলেও মনে পড়ে।

মায়ের সমকক্ষ করে পৃথিবীতে স্রষ্টা আর কাউকে সৃষ্টি করেননি। মায়া-মমতা ভালোবাসার আদলে সন্তানকে আঁকড়ে রাখার ক্ষমতা মায়ের মতো অন্য কাউকে স্রষ্টা দেননি। বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তানসহ পৃথিবীর সকল আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের মমত্ববোধকে ভালোবাসাকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয় এবং মায়ের ভালোবাসা যদি আরেক পাল্লায় রাখা হয় তাহলেও মায়ের পাল্লাটি হবে বহু বহু বহু গুণ ভারী।

ছেলেবেলায় আমি খুব নিরীহ প্রকৃতির ছিলাম। আর সে কারণেই হবে হয়তো সব সময় মায়ের আঁচল ধরেই থাকতাম। সে সময় মায়ের কাছে অনেক গল্প শুনেছি আমি- যা এখনও মনে আছে। তার একটি গল্প এই লেখাটির জন্য খুব উপযোগী বলে মনে হচ্ছে। আমার মায়ের মুখে শোনা সেই গল্পটি এমন–

এক বিধবা তার ছেলেকে বহুকষ্টে বড় করেছেন। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-খরা উপেক্ষা করে অন্যের বাড়ি কাজ করে যা পেতেন তাই সন্তানের মুখে তুলে দিতেন। একসময় এ সন্তানটি যুবক হলো সেও কাজ করতে শুরু করলো। মাকে বললো, ‘অনেক হয়েছে মা, এখন তুমি বিশ্রাম করবে। এখন আমার পালা। সারাটি জীবন তুমি কষ্ট করেছ। কষ্ট কী জিনিস আমাকে বুঝতে দাওনি। এখন থেকে আমি তোমাকে সেই কষ্টটা বুঝতে দেবো না। রাজরানীর মতো থাকবে তুমি। মা তার স্বভাবসুলভ ভাবেই দুই হাত আকাশের দিকে তুলে মন ভরে দোয়া করলেন- হে আল্লাহ আমার সন্তানকে জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে জায়গা করে দিও।

আরও পরে অনেক দেখে শুনে পরমা সুন্দরী এককন্যা বিয়ে করানো হলো ছেলেকে। বউটিও বেশ ভালো। সুখের সংসার তাদের। মা আবার শুকরিয়া আদায় করলেন। বললেন -হে আল্লাহ তুমি মহান, তুমি মেহেরবান।

দিন যায় মাস যায় চলে যায় বছর। একদিন এক অমানিশার রাতে ছেলেটির স্ত্রী-স্বামীকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো’। উত্তর খুব সহজ- ‘সম্রাট শাহজাহানের চেয়েও বেশি। স্ত্রীর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সেও তাজমহল বানিয়েছে, আমিও বানিয়েছি। সে বানিয়েছে আগ্রায়, আমি বানিয়েছি আমার বুকের ভেতর-যেটা তার চেয়েও বহু গুণ সুন্দর’। স্ত্রী বলল , ‘আমি বিশ্বাস করি না’। স্বামীর উত্তর অত্যন্ত সহজ-পরীক্ষা নিয়ে দেখো। স্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তাই যদি হয় তবে আজ এই অমানিশার রাতেই তোমার মা’র কলিজাটা এনে আমাকে উপহার দিতে হবে। এখনই দেখা যাবে তোমার ভালোবাসার জোর কতটুকু’।

স্ত্রীর রুদ্র মূর্তি ধারণ করে সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বললো, ‘মনে রেখো এমনও হতে পারে এই রাতই আমাদের জীবনের শেষ রাত। তুমি আমার কথা মতো কাজ না করলে প্রত্যুষে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবো আমি’।

আকাশ ভেঙে পড়লো ছেলেটির মাথায়। কোন দিকে যাবে সে- মা না স্ত্রী! রাত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকলো। একসময় ছেলেটি দৌড়ে নিজের শোবার ঘরে ঢুকলো এবং ঘরে রক্ষিত রামদাটি নিয়ে বের হলো। কোন দিকে যাবে? ডানে পাহাড়ের মাথায় উন্মুক্ত স্থানে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে আর বামে ঘরের মধ্যে মা ঘুমিয়ে আছেন। প্রথমে ছুটলো মায়ের ঘরের দিকে। রামদা দিয়ে বক্ষ ছিড়ে মায়ের কলিজা হাতে নিয়ে যখন সে স্ত্রীর দিকে দৌড়ে আসছে তখন এক পর্যায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো ছেলেটি। পাহাড়ের গায়ে পাল্টি খেলো কয়েক বার। হাতের মুঠোতে তখনও মায়ের কলিজা। কলিজা কেঁদে উঠল। বলল, ‘আহারে বাবা ব্যথা পেলি না-তো’!

সন্তানের জন্য মা যে বিধাতার কী আমানত তা অংক করে মিলিয়ে দেখা যায় না! একজন মা মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে সন্তানকে জন্ম দেন। লালন-পালন করেন। মানুষ করেন এবং তারপর ধীরে ধীরে বার্ধক্যে উপনীত হন এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে সন্তানকে পৃথিবীতে রেখে পরপারে পাড়ি জমান। এই ক্ষমতা আল্লাহ-তাআলা আর কাউকেই দেননি। এ জন্যেই প্রতিটি ধর্মেই মায়ের স্থান দেওয়া হয়েছে পার্থিব জগতের সর্বোচ্চ আসনে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবদ্দশায় বহুবার বহুভাবে এই সত্য প্রতিষ্ঠার উদাহরণ রেখেছেন। এমনকি তার দুধ মা যখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তখন তিনি তার মাথার পাগড়িটি খুলে বিছিয়ে দিতেন যার উপর দিয়ে হেঁটে আসতেন তার দুধ মা।

পবিত্র কোরআনে বহুবার বলা হয়েছে মায়ের মর্যাদার কথা। সূরা বনি ইসরাইলের মানুষের জীবনধারণের জন্য আল্লাহ জন্য যে চৌদ্দটি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো মা-বাবাকে নিয়ে। এই সূরার ২৩ আয়াতের মর্মবাণী হলো ‘বাবা মার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তোমার জীবন দশায় তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয় তবুও তাদের ব্যাপারে ওহ আহ পর্যন্ত করো না। তাদের ধমক দিওনা। আদবের সাথে কথা বলো। শ্রদ্ধা ভরা দৃষ্টিতে মমতার ডানা মেলে ছায়ার মতো আগলে রেখো এবং সব সময় তাদের জন্য দোয়া করো ‘হে আমার প্রতিপালক আমার মা-বাবা শৈশবে যে মমতায় আমাকে লালন করেছেন তুমিও তাদের উপর সেরূপ করুণা বর্ষণ করো।’

এতদসত্ত্বেও কী বিচিত্র আমরা! এই করোনাকালে করোনা আক্রান্ত মাকে আমরা জঙ্গলে ফেলে এসেছি! পক্ষাঘাতগ্রস্থ বৃদ্ধা মা মরছে না দেখে বহুতল ভবন থেকে তাকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছি! চালিয়ে দিতে চেয়েছি আত্মহত্যা হিসেবে!

এইসব ব্যত্যয় গুলোকে আমরা ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে নিতে চাই এবং আজকের এই মা দিবসে শপথ নিতে চাই যে- মায়ের তুলনা শুধু মা ছাড়া আর কেউ নন। মা পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার। স্রষ্টাকে পাওয়ার সর্বোত্তম মাধ্যম হলো মা। সর্বোপরি শুধু একটি দিনকে কেন্দ্র করে এই মহা সত্যকে পালন সম্ভব নয়- এটাই শেষ কথা নয়। এখন থেকে প্রতি দিবসই হোক মা দিবস।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সূত্র : বাংলাট্রিবিউন

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে