করোনায় মানসিক সংকট মোকাবিলা অতি জরুরি

প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২১; সময়: ১:২৫ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
করোনায় মানসিক সংকট মোকাবিলা অতি জরুরি

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ : এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় চোদ্দ কোটি মানুষ, মারা গেছেন প্রায় ঊনত্রিশ লক্ষ। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ ষাট হাজার জন সংক্রমিত হয়েছেন। আর মৃত্যুর সংখ্যা ১০ হাজার ৪৯৭ জন! সবাই জানে করোনা (কোভিড-১৯) একটি ভাইরাসজনিত রোগ কিন্তু এ রোগটির ব্যপ্তি এতই বেশি যে তা শারীরিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতাকে অতিক্রম করে মানসিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলছে।

করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতার সম্পর্ক এখন সর্বজনস্বীকৃত। এমনকি সেপ্টেম্বর ২০২০-এ ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রির্চাড হর্টন তার ‘কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি (এপিডেমিক) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়। মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে করোনায় সংক্রমিত মানুষের প্রতি পাঁচ জনের একজনের মধ্যে করোনার সাথে মানসিক সমস্যা (বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, সাইকোসিস ইত্যাদি) দেখা দেয়। আবার কোভিড সংক্রমিত নন এমন ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, প্যানিক অ্যাটাকের হার সাধারণ সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায় বলে প্রমাণিত। এমনকি করোনা থেকে সেরে উঠলেও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি কিন্ত থেকেই যায়। এপ্রিল ২০২১ এ ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় এ প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী করোনা থেকে সেরে উঠার প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই প্রতি ৩ জনে ১ জনের মধ্যে এমন মানসিক সমস্যা দেখা গেছে যেটার চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রায় ১৭শতাংশ-১৯শতাংশের মধ্যে অতি উদ্বেগ, ১৪ শতাংশের মধ্যে মুড ডিসওর্ডার আর ১.৫ শতাংশ-২.৭ শতাংশের মধ্যে গুরুতর মানসিক রোগ (সাইকোসিস) দেখা গেছে। প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার করোনা থেকে সেরে ওঠা মানুষের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গবেষণা চালানো হয়। করোনার মনোসামাজিক প্রভাব এত এত বেশি যে এটি প্যানডেমিককে অতিক্রম করে সিনডেমিক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক জাতীয় জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষণ্নতা আর ৪.৭ শতাংশ ছিল এংজাইটি সমস্যা। কোভিডকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে অ্যাংজাইটি আর ৪৬শতাংশের মাঝে বিষন্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ সাধারণ সময়ের চেয়ে কোভিডকালে মানসিক সমস্যা বাংলাদেশেও বেড়ে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা ঘটেছে প্রায় চৌদ্দ হাজার যা বিগত বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড ইস্যুতেই (কোভিড নিয়ে কুসংস্কার, স্টিগমা, কোভিডভীতি) প্রায় ৫ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মরে যাবার ভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা, বেকারত্ব, এমন করোনা নিয়ে ভ্রান্ত-নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। আর করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস বার্নআউট হচ্ছে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এমনকি করোনাকালে বিশ্বজুড়ে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা।

প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোর আর তরুণদের ওপরেও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, জীবন যাত্রার রুটিন পরিবর্তন আর পরিবারে গুণগত সময় না পাওয়ায় তাদের মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হচ্ছে, বাড়ছে অনলাইন আসক্তি আর আচরণজনিত সমস্যা। শিশু-কিশোর আর তরুণদের মধ্যে আবেগের উঠানামা, ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, ভালো লাগার বিষয়গুলোও ভালো না লাগা, খিটখিটে মেজাজ, রেগে যাওয়া, আগ্রাসী আচরণ, নিজের ক্ষতি করা ও আত্মহত্যা প্রবণতা এবং ঘুমের সমস্যা উপসর্গ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।

কেন বাড়ছে মানসিক সমস্যা:

*করোনা সংক্রমনের আশংকা প্রত্যেকের মনে বাড়াচ্ছে মানসিক চাপ।
*সংক্রমিত হয়ে মরে যেতে পারি এই ভাবনা মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
*সংক্রমিত হলে চিকিৎসার সুযোগ পাবো কিনা সেটা নিয়ে আতংক।
*পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত হবার ভয়।
*সংক্রমিত হলে আইসোলেশনে থাকার সময় একাকিত্ব মনের ওপর চাপ বাড়ায়।
*কাছের মানুষের মৃত্যু আমাদের মনকে শোকাতুর করে তোলে।
*সংক্রমন নিরসনে কখনও কখনও পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করে।
*সংবাদ মাধ্যমে ভীতিকর চিত্র বা সংবাদ দেখে আতঙ্ক বোধ করা।
*যিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন তিনি যখন দেখেন যে বেশিরভাগ মানুষই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না তা দেখে তিনি মানসিক চাপ অনুভব করেন।
*চিকিৎসাসেবা কর্মীগণ বাড়তি কাজের চাপ, কর্তৃপক্ষের অবিমৃষ্যকারী দৃষ্টিভংগি ইত্যাদি কারণে স্ট্রেস আর বার্নআউটের মুখোমুখি হচ্ছেন, ফলে তাদের মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হচ্ছে।

মানসিক সমস্যা হলে কী ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে:

Ø ঘুমের সমস্যা। ঘুম না আসা, বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া বা খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অথবা রাতে জেগে থাকা আর দিনে ঘুমানোর প্রবণতা।

Ø মন খারাপ থাকা।

Ø অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় থাকা, অস্থিরবোধ করা।

Ø একই চিন্তা বারবার মনে আসা বা একই কাজ বারবার করা।

Ø হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে মৃত্যুভয়ে ভীত হওয়া।

Ø কোনও কিছুতে এমনকি আনন্দের বিষয়েও আনন্দ না পাওয়া।

Ø মেজাজ খিটখিটে থাকা, হঠাৎ রেগে যাওয়া।

Ø মনোযোগ কমে যাওয়া, সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়া।

Ø নিজেকে অপরাধী ভাবা।

Ø আগ্রাসী আচরণ করা।

Ø নিজের ক্ষতি করা বা আত্মহত্যার চিন্তা মনে আসা।

এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক:

মনে রাখতে হবে এই সংকটময় মুহূর্তে আতংকিত হওয়া, মানসিক চাপে পড়া বা হতাশবোধ করাই স্বাভাবিক। পুরো বিশ্ব একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এসময় কোনও ব্যক্তিকে ‘আতঙ্কিত হবেন না’, ‘মানসিক চাপে ভুগবেন না’ বা ‘অস্থির হবেন না’- এইগুলো বললে সে আরো বিরক্তবোধ করবে, তার মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে গেলে কিন্তু তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে সংক্রমণের ঝুকিঁ বেড়ে যাবে, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে আতঙ্ক আর স্ট্রেস তার করোনাকে আরো জটিল করে তুলবে। তাই সকলকে মানসিক চাপ মোকাবিলায় দক্ষতা বাড়াতে হবে।

মানসিক সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে:

*যা আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই সেটা নিয়ে ভাবনা বন্ধ করে যেটা আপনার নিয়ন্ত্রণে আছে সেটার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। যেমন, কীভাবে করোনা দূর হবে, টিকা কাজ করবে কি করবেনা এগুলো না ভেবে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া আর শারীরিক দূরত্ব রক্ষার দিকে মন দিতে হবে।
*জীবন যাপন পদ্ধতিতে এমন কোনও পরিবর্তন আনবেন যা আপনার জন্য ক্ষতিকর। যেমন সারা রাত জেগে থাকা আর সারাদিন ঘুমানো চলবেনা।
*পরিবারের কোনো সদস্য বা আপনি নিজে করোনায় আক্রান্ত হলে কেবলমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। চিকিৎসক নন এমন ব্যক্তির কথিত অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত পরামর্শ কখনওই গ্রহণ করবেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব তথ্য বিজ্ঞানসম্মত নয়, এটাও মনে রাখবেন।
*পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটান, সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করুন, রুটিন বিষয়গুলো, যেমন ঘুম, ঠিক সময়ে খাবার, বাড়িতে হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি বন্ধ করবেন না। সুষম আর নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করুন। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। সময়মতো ঘুমান, হালকা ব্যায়াম করুন এবং ঘরের কাজে সবাই মিলে অংশ নিন। ধূমপান, মদ্যপান বা নেশা এড়িয়ে চলুন।
*সারাদিন করোনা করোনা করবেন না। জীবনের অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকেও খেয়াল রাখুন। নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মচর্চা করতে পারেন। বই পড়া গান শোনা বা ইচ্ছামতো ছবিও আঁকতে পারেন। বাড়িতে সবাই মিলে ক্যারাম লুডু খেলতে পারেন।
*পরিবারের দূরের সদস্য আর বন্ধু বান্ধবের সাথে অনলাইনে, টেলিফোনে যোগাযোগ রাখুন। একে অপরের খোঁজ নিন।
*বাড়িতে রিলাক্সেশন, ইয়োগা, মাইন্ডফুলনেস এর চর্চা করতে পারেন। ইউটিউব থেকে সহজেই এগুলো শিখে নিতে পারবেন।
*বাড়ির শিশুটির দিকেও খেয়াল করুন। শিশু বা তার পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজনীয়তা শিশুর সঙ্গে আলোচনা করে রাখুন, তাকে জানিয়ে রাখুন যে জরুরি প্রয়োজনে পরিবারের কোনও না কোনও সদস্য কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। শিশুদের সাথে সময় কাটান, তাদের সাথে খেলুন, গল্প করুন বা একসাথে মুভি দেখুন।
*নিজেকে ধন্যবাদ দিন। সুস্থভাবে নিয়ম মেনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পেরেছেন এজন্য নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। এতে আপনার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে যাবে।
*প্রতিদিন কিছুটা সময় দিনের আলোতে জানালার পাশে বা বারান্দায় বসুন।
*যদি মানসিক ভাবে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং মানসিক সমস্যার লক্ষণগুলো আপনার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠতে থাকে তবে অবশ্যই অনলাইনে বা সরাসরি সাইকয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করুন।
*যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্য বাতায়ন ৩৩৩ বা ১৬২৬৩ সম্বরে যোগাযোগ করতে পারেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

 

সূত্র : বাংলাট্রিবিউন

  • 20
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে