করোনার নতুন ঢেউ মোকাবিলায় যা যা করা যায়

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২১; সময়: ৯:১৫ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
করোনার নতুন ঢেউ মোকাবিলায় যা যা করা যায়

বদিউল আলম মজুমদার : কয়েক মাস আগে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ও সংক্রমণের হার এমন নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে অনেকে ধারণা করেছিলেন, আমরা ভাইরাসকে জয় করে ফেলেছি। কিছু কিছু নীতিনির্ধারক তখন গর্ব ভরে করোনাকে ঝেঁটিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিদায় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কেউ কেউ তো ‘যা উন্নত দেশগুলো পারেনি, তা আমরা পেরেছি,’ দাবি করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত করোনার নতুন ঢেউ ভয়াবহ আকারে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সরকার নিরুপায় হয়ে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে।

কিন্তু লকডাউন অনির্দিষ্টকাল চললে তো অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে যাবে। আর লকডাউন তো সমাধান নয়, বরং সমাধানের উপলক্ষমাত্র। সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনকালে এবং পরে আমাদের কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিতে হবে।

এক বছর ধরে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট ‘করোনা-সহিষ্ণু গ্রাম’ (‘করোনা রেজিলিয়েন্ট ভিলেজ বা সিআরভি) নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছি। একদল স্বেচ্ছাব্রতীদের নেতৃত্বে সারা দেশের প্রায় ১ হাজার ২০০ গ্রামে উদ্যোগটি পরিচালিত হচ্ছে। এ কাজে সহায়তা করেছে এসডিসি ও কানাডিয়ান হাই কমিশন। এ উদ্যোগের অভিজ্ঞতা জাতি হিসেবে আমাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

সিআরভির মূল লক্ষ্য ছিল ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, অভ্যাস পরিবর্তন ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্তকরণ। দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন ইউনিয়নে জনগণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সমাজের সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বকারী একদল স্বেচ্ছাব্রতীর যৌথ উদ্যোগে ‘এসডিজি ইউনিয়ন স্ট্র্যাটেজি’ নামের একটি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সরকারও মহামারি প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রতি ইউনিয়নে ‘করোনা প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করতে সার্কুলার গত বছর জারি করেছে। বহুলাংশেই এটি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল। সিআরভি উদ্যোগের অংশ হিসেবে চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে আমরা এ কমিটিগুলো পুনর্গঠন করেছি। এ ছাড়া গ্রাম পর্যায়ে সব স্তরের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে আমরা ‘সিআরভি কমিটি’ গঠন করেছি।

কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা আমাদের এ উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য। স্বেচ্ছাব্রতীরা প্রথম থেকেই তাদের নিজ গ্রামে—আমরা সবাই সমান ঝুঁকিতে আছি—গ্রামের মানুষের মধ্যে এ সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। তারা গ্রামের সবার মধ্যে এ চেতনা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছে যে প্রত্যেক ব্যক্তি, এমনকি সবচেয়ে দরিদ্রতম ব্যক্তিরও করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষাই কেবল সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বেচ্ছাব্রতীরা ৩ ডব্লিউ (ওয়াশিং হ্যান্ডস, ওয়াচিং ডিসটেন্সেস, ওয়্যারিং মাস্কস) কর্মসূচি পরিচালনা করেছে। নাম থেকেই বোঝা যায় লক্ষ্য ছিল হাত ধুতে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং মাস্ক পরতে মানুষকে উৎসাহিত করা। মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন দুরূহ ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ, স্বেচ্ছাব্রতীরা ২০-২৫টি পরিবারের সঙ্গে নানা ধরনের তথ্যসংবলিত লিফলেট নিয়ে তাই বারবার বসেছে। আমাদের প্রশিক্ষিত নারীনেত্রীরা গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করে করোনাকালে পুষ্টি বিষয়ে মায়েদের সচেতন করেছে। স্বেচ্ছাব্রতীরা ইমাম-পুরোহিত এবং সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দিয়ে করোনা বিষয়ে ভুল ও বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করেছে। মানুষকে করোনা পরীক্ষা এবং রোগীদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যাপারেও তারা সহায়তা করেছে। এখন তারা গ্রামের মানুষকে টিকা নিবন্ধন করে দিচ্ছে।

আমাদের স্বেচ্ছাব্রতীরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। অনেকগুলো ক্লিনিকে তারা অক্সিমিটার, ডিজিটাল থর্মোমিটার ও রক্তচাপ মাপার যন্ত্র দিয়েছে। তারা ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা কমিটিকে সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। জীবিকা হারানো বিপন্ন মানুষের পাশেও স্বেচ্ছাব্রতীরা দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র মানুষের মধ্যে সবজি বীজ বিতরণ করেছে। যোগ্য ব্যক্তিদের সরকারের বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। এ ছাড়া বিপন্ন পরিবারের মধ্যে তারা কয়েক কোটি টাকার অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করেছে।

এ চলমান উদ্যোগ থেকে আমরা লক্ষ করেছি যে আমাদের কর্ম এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। মাস্ক পরার হারও বেশি। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে সচেতনতার মাত্রাও অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি। সিআরভি উদ্যোগ থেকে অনেকগুলো শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক শিক্ষাটা হলো, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলাকায় এলাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আপামর জনগণ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাই করেছিলেন, তাই আমরা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানিদের মাত্র নয় মাসে পরাভূত করতে পেরেছি। করোনার বিরুদ্ধেও আমাদের আরেকটি জনযুদ্ধ শুরু করতে হবে। আজও প্রত্যেক নাগরিককে এ অদৃশ্য শত্রুকে প্রতিহত করতে হবে, অস্ত্রের দ্বারা নয়, অভ্যাস ও আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, করোনাভাইরাসকে সফলভাবে প্রতিহত করতে হলে রিস্ক কমিউনিকেশন হতে হবে সৎ ও স্বচ্ছ। কিন্তু আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অতীতের বক্তব্য সৎ ও স্বচ্ছ ছিল না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই ছিল পক্ষপাতদুষ্ট ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ। টিকা ব্যবস্থাপনাও এমন করা হয়েছে যে শিক্ষিত এবং বিত্তবানেরাই এই সুবিধার সুফল পাচ্ছেন। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকদের ওপর আস্থাহীনতার জন্য সাধারণ মানুষকে কি দোষ দেওয়া যায়?

তাই আজকের জরুরি পরিস্থিতিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে আমাদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় মানুষকে সংঘবদ্ধ করে তাদের আচরণ বদলানোর উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষকে আস্থায় নিতে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের সিআরভি উদ্যোগের উদ্দেশ্যই ছিল এমন একটি প্রচেষ্টা শুরুর ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহী করা।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেনের মতে, ‘আপনাদের সিআরভি মডেল, শুধু গ্রামই নয়; নগর ও শহরেও বাস্তবায়নযোগ্য। মডেলটি সারা দেশে ব্যবহৃত হলে এক মাসের মধ্যে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্য দেশগুলোও আমাদের অনুসরণ করবে।’

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেবেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার কান্ট্রি ডিরেক্টর, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট

সূত্র : প্রথম আলো

  • 15
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে