অশনি সংকেত সরকারের জন্যে, আমাদের জন্যেও

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২১; সময়: ৬:৩৯ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
অশনি সংকেত সরকারের জন্যে, আমাদের জন্যেও

মাহফুজ আনাম : হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে লোক দেখানো কারণটি হচ্ছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর। কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে এটাই সবাইকে জানানো যে হেফাজতে ইসলাম এখন আর তাদের সাবেক প্রধান শাহ আহমেদ শফী এবং তার অনুসারীদের নিয়ে গঠিত সংগঠনটির মতো নেই, তারা এখন নতুন নেতৃত্বে একটি নব্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় বিশ্বাসকে রক্ষার ছদ্মবেশে। সঙ্গে এটিও প্রতীয়মান হয়েছে যে সরকার হেফাজত তোষণের যে নীতি নিয়েছিল, তা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আপস ও ছাড় দেওয়ার অপরিণামদর্শী মনোভাব দেখিয়ে তাদেরকে এতটাই শক্তিশালী করা হয়েছে যে তারা এখন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বদলে দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতার দাপট ও অহংকারে অন্ধ হয়ে সকল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মিত্রদেরকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শেখ হাসিনা একটি বিকল্প ইসলামিক শক্তির উত্থান চেয়েছিলেন। এর জন্য বেছে নেওয়া হয় কওমি-মাদ্রাসা ভিত্তিক হেফাজতে ইসলামকে। সরকারের জন্য এর স্বপক্ষে যুক্তিগুলো যেমন ছিল সরল তেমনি আকর্ষণীয়। আওয়ামী লীগের এমন একটি ‘ইসলামী দল’ প্রয়োজন ছিল যারা কোনোভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল না। এরকম একটি শক্তির সঙ্গে মিলে খুব সহজেই জামাতকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে আওয়ামী লীগ।

২০১৩ সালের মে মাসের ঘটনার পর সরকার হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে, বিশেষ করে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। কওমি মাদ্রাসা থেকে দেওয়া সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে স্নাতকোত্তরের সমমর্যাদা দেওয়ার পর শফী ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর এক জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ খেতাব দেন।

এই স্বীকৃতি দেওয়ার বাহ্যিক কারণ হচ্ছে সরকার কওমি পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে বের হওয়া হাজারো ছাত্রকে ‘মূলধারা’র বাইরে রাখতে চাইছিল না। কিন্তু আসল কারণ ছিল রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া। এই সিদ্ধান্তটি প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি, শিক্ষাদান পদ্ধতি, কী কী বিষয় সেখানে পড়ানো হবে ও শিক্ষকদের যোগ্যতার মাপকাঠির ব্যাপারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা আলিয়া মাদ্রাসার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আলিয়া মাদ্রাসার পঠনপাঠনের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। তারপরও, কওমি মাদ্রাসা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল। হেফাজত বিরামহীনভাবে এই দাবিটি জানিয়ে আসছিল এবং এই স্বীকৃতি ছিল তাদের জন্য ভীষণ আকাঙ্ক্ষিত বিজয়। এর বিনিময়ে হেফাজত অনুগত ও চুপচাপ থাকল এবং শেখ হাসিনা সমাজের বাকিদেরকে তার নিজের উদ্ভাবিত রাজনৈতিক ফর্মুলা জোর করে গিলতে বাধ্য করলেন।

আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন—ইসলামী শক্তিগুলোতে বিভক্তি এনে, প্রথাগত বিরোধীদলের পরিবর্তে একটি অনুগত দলকে বসিয়ে এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের মুখ বন্ধ করে শান্তিতে দেশ শাসন করবেন। কিন্তু এই রাজনৈতিক ফর্মুলা কখনই পৃথিবীর কোথাও কাজ করেনি এবং বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মৌলবাদী শক্তিগুলোর মূলনীতি ভিন্ন। তারা শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিকভিত্তি ছাড়া কৌশলের অংশ হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়।

যে উদ্দেশ্যেই হেফাজতে ইসলাম গঠিত হোক না কেন, বাস্তবে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। গেল বছরের ৯ ডিসেম্বর আমাদের জ্যেষ্ঠ সংবাদদাতা রাশেদুল হাসানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘হেফাজতে ইসলাম এখন একটি রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি কিছু যারা কৌশলগত কারণে দাবি করে যে তাদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই।’ হেফাজতের নতুন কমিটিতে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এক তৃতীয়াংশ নেতা এসেছেন বিএনপির ২০ দলীয় জোটের দলগুলো থেকে।

২০০৯ সালের খসড়া ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’তে সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকরা মিলে ২০১০ সালে হেফাজত গঠন করেছিলেন। তবে ২০১৩ সালে শাহবাগে ছাত্ররা ১৯৭১ সালের সব যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করার পরেই মূলত হেফাজতের উত্থান দেখা যায়। হেফাজত শাহবাগের উত্তর দিয়েছিল শাপলা চত্বরে একটি জঙ্গি সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে, যেখানে তারা ব্লাসফেমি আইন, নাস্তিকদের শাস্তি, স্কুলের পাঠক্রমে পরিবর্তন আনাসহ ১৩ দফা দাবি তোলে। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল মূলত যারা উদারনৈতিক মূল্যবোধ ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, তারা।

শাপলা চত্বরে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটার পর সরকার হেফাজতের সঙ্গে পর্দার আড়ালে সমঝোতা করে। যেখানে ১৩ দফা দাবি থেকে বেশ কিছু দাবি মেনে নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি ভঙ্গুর সমঝোতা হয় যা টিকে থাকে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর হেফাজতের আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যায় এবং তা সরকার-বিরোধী অংশের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

শেখ হাসিনা সরকারের পরিণতিকে প্রচলিত বাগধারা ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’র মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। সরকার সবজান্তা মনোভাবের কারণে ভুলগুলোও এড়াতে পারেনি এবং কোনো বিকল্প সমাধানের দিকেও যায়নি। এটা আগে থেকেই প্রমাণিত যে তোষণ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু সরকার এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করতে পারেনি।

অপরদিকে, স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ, বিএনপিকে আক্রমণ করে। তাদের অনেক ত্রুটি থাকলেও, তারা ধর্মভিত্তিক সংগঠন নয়। বিএনপিকে ধ্বংস করার অদম্য তাড়নায়, সরকার আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি অসাম্প্রদায়িক বিকল্পকেও ধ্বংস করছে। তবে বিএনপির অসাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল জামাতের সঙ্গে জোট করার পর, যা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আছে। এ ছাড়াও, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে তাদের দ্বিধান্বিত অবস্থান ও মনোভাবের কারণেও বিএনপির অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের আঘাত লাগে।

একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল নাগরিক সমাজকে নিয়ে বিদ্রূপ করতে শুরু করে এবং তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেয় করতে শুরু করে। সরকার তাদেরকে ‘আবর্জনার বিন’ অভিহিত করে এবং দাবি করে যে তারা ‘আমাকে ব্যবহার করুন’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অর্থাৎ তারা এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত ও নৈতিকতা বিবর্জিত যে যারাই তাদেরকে টাকা দেবেন, তারা তাদের পক্ষেই কাজ করবেন।

একই ধরনের বিপাকে পড়তে হয় এনজিওগুলোকেও। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু মৃত্যুর হারসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের কয়েক দশকের অবদানকে সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করা হয় এবং তাদেরকে চিত্রিত করা হয় বিদেশি তহবিলের ব্যবহারকারী হিসেবে। তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দেওয়া, নারীর ক্ষমতায়নের পেছনে মুখ্য ভূমিকা রাখা এবং দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধকে এগিয়ে নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর জন্য তাদেরকে কখনই উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হয়নি। ক্ষুদ্র ঋণের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা সারাবিশ্বে দারিদ্র্য দূর করার একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে একে নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে এবং এটিকে গরিবদের ফাঁদে ফেলে তাদের ওপর আরও বেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এনজিওর সব অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এক ধাক্কায় দেশের স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিকভাবে বিরুদ্ধাচরণকারীদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঘৃণা ছড়ানো এবং সার্বক্ষণিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হেয় করা অন্ধ ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মুখোমুখি হতে হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সরকারের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে; যারা তাদের রাজনীতি ও প্রত্যেকটি কথায় আমাদের সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলোকে আঘাত করছেন, তাদের জন্য নয়।

নাগরিক সমাজ, এনজিও ও স্বাধীন গণমাধ্যম, এ সবই বাংলাদেশের বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত উন্নয়নের যাত্রাপথে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে অবদান রেখেছে—যে উন্নয়নকে আমরা ১০ দিন ধরে জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপন করলাম। এ শক্তিগুলোকে সরকার অবজ্ঞা, অসম্মান ও দমন করে এসেছে, কিন্তু এরাই সামগ্রিকভাবে সরকারের হাতকে শক্তিশালী করে তুলতে পারত সেসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধের লড়াইয়ে যাদের জঘন্য কর্মকাণ্ড আমরা সম্প্রতি দেখলাম।

বাংলা প্রবাদ ‘আলোর নিচে থাকে অন্ধকার’। সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত জায়গাতেও কালো দাগ থাকে, তেমনি, আমাদের এই অসাধারণ সাফল্যের মাঝেও আমরা একটি গুরুতর দুর্বলতাকে বহন করে চলেছি।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নীতি পুনর্মূল্যায়নের এখনই সময়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তাদের জন্যে একটি অশনি সংকেত। আমাদের জন্যেও।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে