ভারতে কৃষির কালো আইন, বাংলাদেশে কি সাদা?

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১; সময়: ৫:৩১ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ভারতে কৃষির কালো আইন, বাংলাদেশে কি সাদা?

ফরিদা আখতার : কোভিড সংক্রমণ ও ভ্যাক্সিনের আন্তর্জাতিক খবর ছাপিয়ে যে খবরটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষের নজর কেড়েছে তা হচ্ছে ভারতের কৃষকের আন্দোলন। বহুদিন কৃষকের এমন আন্দোলন দেখে নি কেউ। এর আগের বছর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এমনই কনকনে শীতের মধ্যে এনআরসি বিরোধি দিল্লীর আন্দোলনও দৃষ্টি কেড়েছিল।

প্রায় ৭০ দিনের বেশি সময়ে শীত এবং করোনা সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে খোলা রাস্তায় দিল্লীর কয়েকটি সীমান্তে কৃষকরা ট্রাক্টর নিয়ে চলে এসেছেন, হাজারে হাজারে নয়, লাখে লাখে। তথাকথিত আধুনিক কৃষির ভুক্তভোগী তারা। দিনে দিনে এদের সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে। উল্লেখ করার মতো দৃশ্য হচ্ছে নারী কৃষকদের অংশগ্রহণ। তারাও ট্রাক্টর চালিয়ে এসেছেন এবং আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাস্তায় বসে তারা প্রতিবাদের গান জুড়ে দিয়েছেন। বয়স্ক কৃষক নেতাদের সংখ্যা অনেক দেখা যায় কিন্তু তরুণ কৃষকরাও এই আন্দোলনকে জীবন দান করেছে। পুলিশের হয়রানি আছে, কিন্তু কাউকে নিরস্ত বা বিভ্রান্ত করতে পারে নি। পুলিশ তাদের নড়াতে কিম্বা সরাতে পারে নি। তারা বলছে, আমাদের নেতারা বললেই আমরা যাবো, পুলিশের ধমকে নয়।

তাদের খাবার দাবারও চলে আসছে; দিল্লীবাসীদের সমর্থন দেখা যাচ্ছে এই খাবার দাবার সরবরাহের মধ্যেই। যে যা পারে দিয়ে যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণের ভয় কারো নেই, কোন মাস্ক পরা হচ্ছে না, নেই কোন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অবস্থা। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছেন করোনার ভয় আছে কিনা। হেসেই উত্তর দিয়েছেন কৃষকরা, করোনা আমাদের কাছে আসবে না। কি তাদের শক্তি? তাদের এতো দৃঢ়তা কোথা থেকে আসছে? তাদের দাবি যে তিনটি আইন পাশ করা হয়েছে সেগুলো বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা এক পাও সরবেন না। দিল্লী পুলিশ কঠোর হওয়ার সব ব্যবস্থা নিয়েও কৃষকদের হঠাতে না পেরে পিছিয়ে এসেছে। সরকার এই আইন আপাতত স্থগিত করার ঘোষণা দিলেও কৃষকরা বলছেন কালো আইন বাতিল করতে হবে, স্থগিত নয়। এর মধ্যে সংস্কারের কিছু নাই, স্থগিত করতে হবে কেন? স্থগিত করেই বা কি হবে? একমাত্র বাতিল করা ছাড়া আর কোন সমাধান কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর বুঝতেই চাইছেন না যে এই আইন নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে দরাদরি করার কিছু নাই। এগুলো ‘কালো আইন’। এমনই নির্বোধ তিনি, সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন এই আইনে ‘কালো’টা কি? আন্দোলনের ৭২ দিন পর কৃষি মন্ত্রীর এই প্রশ্ন সকলের মধ্যে কৌতুকের উদ্রেক করেছে। এতোদিনেও তিনি যখন এই কথাটি বুঝতে পারেন নি তাহলে আর বুঝবেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এর সাথে জড়িত যে স্বার্থ গোষ্ঠি আছে তাদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তার মাথা আর কাজ করছে না।

আইনই যদি করতে হয় তাহলে কৃষকদের দাবি হচ্ছে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে (এম-এস-পি) আইনী রূপ দেওয়া হোক। এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তারপরও এম-এস-পি কৃষকদের সহায়তা দিত। এর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একে আইনী রূপ দেয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। সেটা না করে কৃষকদের অবাধ বাজার ব্যবস্থার অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যার সুবিধা লুটবে বৃহৎ কোম্পানি। আর অবাধ বাজার ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বাজারের প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল হিশাবে নয়, বরং রাষ্ট্র আইন করে বহুজাতিক কর্পোরেট স্বার্থের আধিপত্য কায়েমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। বাজারে যে দাম পাওয়া যাবে সেটাই কৃষককে মেনে নিতে হবে। আর অবাধ বাজার ব্যবস্থায় কৃষি পণ্যের মূল্য মুনাফা লোভী কর্পোরেট সেক্টরই শেষমেষ ঠিক করে দেয়। কৃষকদের বাজারের নামে বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানির অধীনস্থ করা এবং কৃষি পণ্যের বাজারে কর্পোরেট একচেটিয়া কায়েমই নরেন্দ্র মোদীর কৃষি বিলের উদ্দেশ্য। এমন ব্যবস্থায় আসলে কৃষকদের টিকে থাকাই দায় হবে। যেমন হয়েছে উন্নত দেশের কৃষকদের ক্ষেত্রে। সেখানে আর ক্ষুদ্র কৃষক বলে কিছু নাই। বড় কৃষক হতে না পারলে তাকে কৃষি পেশাই ছেড়ে দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশে কৃষকদের এমন আন্দোলন করতে হচ্ছে না তার মানে এই নয় যে এখানে কৃষকরা ফসলের মূল্য ঠিকমতো পাচ্ছে, কিম্বা তাদের দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং আমদানি করা ফসলের সাথে দামের প্রতিযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ।

এ ছাড়াও দেশের কৃষি ক্ষেত্র ক্রমাগতভাবে গুটিকয় কর্পোরেট কোম্পানির হাতে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে কোন প্রকার নীতিগত সিদ্ধান্ত ছাড়াই। খুব সাধারণভাবে আমরা দেখি প্রতি বছর আমন এবং বোরো মৌসুমের শেষে ফসল ভাল হলে কৃষকের হাসি নয়, কান্না শোনা যায়। ফসল উৎপাদন ভাল হলে সরকার খাদ্যে স্বয়ং সম্পুর্ণতার ঘোষণা দেয়, কৃতিত্ব নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। কিন্তু দেখা যায় বাম্পার ফসলের সময় কৃষক তার ফসলের দাম এতো কম পেয়েছেন যে তার উৎপাদন খরচটুকুও ওঠে না। পত্র-পত্রিকায় এই সময় লেখালেখি হয়, যেমন বোরো ধান উৎপাদনে সার-বীজ-কীটনাশক ও সেচ দিয়ে খরচ কম পক্ষে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা হয়, কিন্তু বিক্রি হয় মাত্র ১০০০ টাকা মণ কিংবা তার চেয়েও কম দামে। কৃষকের শ্রম খরচ তো ওঠেই না, কৃষি উপকরণের জন্যে গ্রহণ করা ঋণও পরিশোধ করা যায় না। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভুমিকা কৃষকের এই দুর্দশা দূর করতে কোন সহায়তা করে না। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আছে বলে শোনা যায়, যার উৎপত্তি বৃটিশ আ্মল থেকে (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার সরকার ১৯৪৩ সালে স্থায়ী ভিত্তিতে কৃষি ও শিল্প অধিদপ্তরের অধীনে কৃষি বিপণন বিভাগ গঠন করেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে উন্নীত করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই অধিদপ্তরের কোন ভুমিকা দেখা যায় কি? কেউ তাদের অস্তিত্ব টের পায় না।

বাজার ব্যাবস্থার ওপরই কৃষককে নির্ভর করতে হয়, তাই অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী সরবরাহ বেশি হলে দাম কমবে, কম হলে দাম বাড়বে তাই ঘটে। এই ব্যবস্থাই চলে আসছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ (৮৪%) কৃষকই ক্ষুদ্র কৃষক, এক হেক্টর জমির কম। তারা বেশি ফসলের সুবিধা নেয়ার জন্যে ঘরে বাড়তি ফসল মজুত করে রাখতে পারে না। তাদের খরচ মেটাবার জন্যে দ্রুত বিক্রি করতে হয়। দাম কম থাকার কারণে এই সুযোগ নেয় মিল মালিক, ফড়িয়া ব্যবসায়িদের সিন্ডিকেট এবং বর্তমান সময়ে দেখা যায় ক্ষমতার সাথে জড়িত রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। দাম কম দেখে কৃষক মাঠের ফসল মাঠেই রেখে দেয়, কারণ শ্রমিক খরচ করে যে ফসল তুলবে তার মূল্য পাওয়া যাবে না, তাই ফসলে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমন শিরোনাম দেখে উত্তেজনা তৈরি হয় সরকার এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে, কিন্তু কোন সুরাহা করার মতো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। শুধু শোনা যায় যে সরকার ক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সে পদক্ষেপ খুবই সীমিত ভাবে কৃষকের উপকারে আসে। সব কৃষকের কাছে পৌঁছায়ও না। দলীয় রাজনীতির কারণে কৃষক ধান বা নৌকা মার্কা হয়ে ভাগ হয়ে যায়। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের কৃষকের ভাগ্য আল্লাহ’র হাতেই ধরা থাকে। ভারতের মতো নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আমাদের নেই, নূন্যতম মূল্যের যে গ্যারান্টির কথা শোনা যায় তা খুব কার্যকর নয়।

অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোন কারণে ফলন কম হলে সরকার তড়িঘড়ি আমদানী করার সিদ্ধ্বান্ত নেয়, যা বাজারে ফসলের দাম কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় নয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, সেটা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে হয় কিনা সেটা খুব কম জানা যায়। কৃষি মন্ত্রণালয় উৎপাদনের পরিমাণ জানতে পারে, ঘাটতি হলে কি করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত খাদ্য মন্ত্রণায়ের। গত আমন মৌসুমের মধ্যে প্রায় ৫ বার বন্যা হয়েছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কোথাও বাম্পার হয়েছে কোথাও কৃষক একটি দানাও তুলতে পারেনি। এই সব কিছুর মধ্যে কৃষকের জন্যে কোন সহায়তা প্যাকেজ নেই। নেই কোন উচ্চবাচ্য।

দেশে আমন ধানের উৎপাদন ঘাটতির কারণে বাজারে আমন ধানের দাম চড়া, ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এর ফলে কৃষকদের একাংশ উপকৃত হয়েছেন। এই দাম কৃষক পেলেও সরকারের নীতি ভিন্ন রকম। সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান না কিনে সস্তা আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। প্রায় ৩ লক্ষ টন ধান আমদানির জন্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কারণ তারা বাজারে চালের দাম বাড়তে দিতে চায় না। সরকারের ধান সংগ্রহের পরিকল্পনা কৃষককে ঘিরে হয় না। তারা মিল মালিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত দামে ধান কেনে। অথচ এই সংগ্রহ সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনলে কৃষক উপকৃত হতে পারতো। পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ঘোষণা দিয়েছেন যে মিল মালিকেরা কম দামে ধান না দিলে তারা আরও সস্তায় আমদানি করবে। ভারত বা অন্য কোন দেশ থেকে। সব আমদানি সরকারি ভাবেও হয় না। প্রাইভেট কোম্পানির পোয়াবারো হয়।

ধান ছাড়া অন্য যে ফসল এই ধরণের আমদানির কারনে বিপাকে পড়ে তা হচ্ছে পেঁয়াজ। দেশে যথেষ্ট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে যে ঘাটতি থাকে তা মেটাবার জন্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য কৃষকদের সহায়তা না দিয়ে প্রতি বছর ভারত থেকেই আমদানি করা হয়। ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভারতের পেঁয়াজ চাষীদের একটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। এবং সেটা হয় প্রথমে ভোক্তার ওপর, ২৫ – ৩০ টাকার পেঁয়াজ হয়ে যায় ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি। অন্যদিকে হঠাৎ ভারতীয় পেঁয়াজ বাম্পার ফলন হলে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আনার কারণে দেশে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের তুলনায় বেশি হয়ে যায়। অর্থাৎ পেঁয়াজ চাষীদের সস্তা আমদানি করা পেঁয়াজের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।

বাংলাদেশ এখনও কৃষি নির্ভর দেশ হিসেবেই পরিচিত, এবং কমপক্ষে ৪০% মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের জায়গা, পরোক্ষভাবে তা ৮০% ছাড়াবে। শহুরে চাকুরিজীবিরা এক পর্যায়ে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন এবং কৃষি কাজেই থাকতে হচ্ছে। কাজেই কৃষি এবং কৃষকের অবহেলা বেশি দিন সহ্য করবে না কৃষকরা। ভারতের অবস্থা সেই ইঙ্গিত কি দিচ্ছে না?

আর, এটা পরিষ্কার কৃষিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি গণ্য করে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে, বাজারের প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সরকারের সুস্পষ্ট ও বিচক্ষণ নীতির অভাবে পুরা অর্থনীতি নির্ঘাৎ ভেঙে পড়বে। অবাধ বাজার ব্যবস্থার নামে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থায় অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া কায়েমের ব্যবস্থা করা স্রেফ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভারতের কৃষকদের বিক্ষোভ জানান দিচ্ছে এই ব্যাপারে আমাদের দ্রুত সোচ্চার হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 19
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে