যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক শাসনের আশঙ্কা!
মনোয়ারুল হক : সামরিক শাসন, পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ এই ব্যবস্থায় দীর্ঘকাল শাসিত হয়েছে। আমাদের এই ভূখণ্ড তথা পূর্ববাংলা ১৯৪৭ সনের পূর্বে ব্রিটিশ শাসনামলে শব্দটির ব্যবহারিক অর্থের সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিল না। শব্দটি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার আগে ছোট ছোট রাজা, রাজ্যগুলোয় সেনাবাহিনীর শাসকের ভূমিকা নেওয়ার ইতিহাস অবশ্য বিদ্যমান। সবচেয়ে শক্তিমান সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল যে মোঘলরা, তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রেও মসনদের পরিবর্তন হয়েছে সামরিক বাহিনীর নানান ভূমিকায়।
১৯৪৭ সনের পর এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান আমলে আমরা (পূর্ব পাকিস্তানবাসী) দুজন সামরিক শাসককে পেয়েছিলাম। তাদের প্রথমজন জেনারেল আইয়ুব খান, তারপর জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এদুজন সামরিক শাসক এই ভূখণ্ডের উপরে যে নির্মমতার চালিয়েছে তার ইতিহাস আমরা কেউই ভুলি নাই।
কিন্তু, সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’র দাবিদার সবচেয়ে শক্তিমানদের কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামোর একটি দেশ যেখানে ৫০টি অঙ্গরাজ্য, সেই দেশটিতেও সামরিক শাসনের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৩ নভেম্বর এর নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতিতে সামরিক শাসনের আশঙ্কা আলোচিত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ২০২০ সালের নভেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে পরাজিত হন বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পরাজয়ের পরদিন থেকেই নানাভাবে তিনি নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্ন তুলছেন। ইতিমধ্যেই, বহুবার ফেডারেল বিচার শরণাপন্ন হয়েছেন, এমনকি সুপ্রিম কোর্টেরও দ্বারস্থ হন। কিন্তু, নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়ার যে আশা তিনি করেছিলেন, তাতে সফলতা পাননি। অবশেষে ট্রাম্প সামরিক শাসনের সম্ভাবনা নিয়ে শলাপরামর্শ করছেন নিজ রিপাবলিকান দল ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সাথে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈচিত্র্যপূর্ণ ফেডারেল কাঠামোর দেশ। এই দেশটিতে প্রায় সকল রাজ্যের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা আইন-কানুন বিদ্যমান। রাজ্যগুলোতে ভোট গণনা, ভোট প্রদান, ব্যালট, আগাম ভোট ইত্যাদি সব বিষয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মতামতের ভিত্তিতে আইন আছে। এমনকি এই নির্বাচনে ভোট গণনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিতর্কের কারণটা হচ্ছে পেনসিলভেনিয়া রাজ্যের নির্বাচনী বিধিমালা। সেই অনুসারে, ভোট গণনা তখনই শুরু হবে যখন আগাম নানান প্রকারের ভোট প্রাপ্তি সম্পন্ন হয়। আবার অন্য রাজ্যে দেখা যায়, ভোট গ্রহণ সময়সীমা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ভোট গণনা শুরু হয়। পেনসিলভেনিয়া রাজ্যটির আইন একেবারে স্বতন্ত্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬৮বার সামরিক শাসনের ইতিহাস পাওয়া যায়। সামরিক শাসনের প্রথম ইতিহাস পাওয়া যায় ১৮১২ সনে নিউ অর্লিন্স রাজ্যে স্থানীয় যুদ্ধের কারণে। এরপরে দেখা যায়, শিকাগো ফায়ারের সময় ১৮৭১ সনে, ওই সময়েও সেখানে সামরিক শাসন ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিসকো’তে ভূমিকম্পের পর জারি হয় সামরিক শাসন। এভাবে নানান রাজ্যে নানান সময়ে বিভিন্ন কারণে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে।
কিন্তু, ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকারের সব রাজ্যে সামরিক শাসন জারি করার কোনো একক ক্ষমতা নেই। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন সামরিক শাসন নিয়ে যত কথাই বলুন, সামরিক শাসন জারি করার আদেশ দেওয়ার সাথে সাথে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা সমর আইন পর্যালোচনা করে দেখবেন যে, এই সামরিক শাসনের আদেশ প্রদান বৈধ না অবৈধ। আইনের বৈধতা না থাকলে, আদেশটি গ্রহণযোগ্যতা নাও পেতে পারে।
১৯৬৩ সালেও সিভিল রাইটস নিয়ে কেমব্রিজ রায়ট হয়েছিল। দাঙ্গার জন্য এমন সামরিক শাসনের নজির পাওয়া যায় যা কেবলমাত্র ৪ বর্গমাইল অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে আবার জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরে এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন। এরকম সামরিক শাসনের সন্ধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যাবে না, সেকারণেই সামরিক শাসনের সম্ভাবনা খুবই কম বলেই ধারণা করা হচ্ছে দেশটির ঐতিহাসিক বাস্তবতায়।
তবে দেশটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কতোটা বিভাজন সৃষ্টি করতে পেরেছেন তার একটি নিদর্শন এই সামরিক শাসন জারি করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। আরও বড় কারণ; ট্রাম্পের রিপাবলিকানরা এখন হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে।
ট্রাম্পের এসব বিষয়ের জন্য সব দায় রিপাবলিকান দলীয় কোনো নেতাকর্মীর নয়। আর ২০১৬ সালে তার হঠাৎ করে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন লাভ দলটির জন্য কতটা সুখকর! অভিজ্ঞতা সামনেও আনবে তা বোঝা যাবে আসন্ন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে। জর্জিয়াতে ৫ জানুয়ারি দুইটি আসনে সিনেট পুন:নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই আসন দুটি বর্তমানে রিপাবলিকানদের অধীন। কিন্তু, নির্বাচনে যদি রিপাবলিকান পার্টি পরাজিত হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, সেটাও ট্রাম্পের নির্বাচন-উত্তর উদ্ভট কর্মকান্ডের ফলাফল। সেকারণে শব্দটি ‘সামরিক শাসন’ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা অবিকল আমাদের মতো ব্যবস্থা নয়।
মার্কিন সামরিক আইনে অবশ্য বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের মতো মিল আছে। যেমন জরুরি মুহূর্তে এমন ব্যবস্থা জারিতে; সিভিল আইন স্থগিত হয় এবং হেবিয়াস কর্পাস স্থগিত হয়। তেমনি আবার আজকের যে প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শাসনের কথা বলা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সে চেষ্টা করে তাহলে তার বাস্তবায়ন হওয়ার প্রথম শর্তই হবে সামরিক বাহিনীর নিজস্ব আইন বিভাগের সমর্থন লাভ করা।
সেজন্যই বৈচিত্র্যপূর্ণ সীমিত সামরিক শাসনের নজির নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আজকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা পৃথিবীর আর কোন ফেডারেল কাঠামোয় গড়ে ওঠেনি। পৃথিবীতে বর্তমানে ২৩ টি জাতিসংঘভুক্ত ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থা আছে। ভারত তাদের অন্যতম। ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে ভারতে কেন্দ্রের কাছে বেশ কিছু ক্ষমতা অর্পিত আছে। যেমন; ভারতের সাংবিধানিক পদে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় মনোনয়নের কোন বিধান নাই।
আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২শ’ পদে রাষ্ট্রপতির অর্থাৎ প্রেসিডেন্টের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষমতা থাকলেও, সিনেট কর্তৃক তার প্রতিটি মনোনয়নের গ্রহণযোগ্যতা অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকও এব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাই দেখা যাক আগামী জানুয়ারির ২০ তারিখ নির্ধারিত দিনে নব-নির্বাচিত জো বাইডেনের কাছে ট্রাম্প কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পন্ন করেন ? নাকি তার স্বপ্নের সামরিক শাসনই তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখবে!
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
18