কোভিড-১৯ এবং শিক্ষায় আমাদের লাভ-ক্ষতি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২০; সময়: ১:৪৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
কোভিড-১৯ এবং শিক্ষায় আমাদের লাভ-ক্ষতি

জি. এম. রাকিবুল ইসলাম : কোভিড-১৯ এর কারণে সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্ব এক সংকটময় অবস্থার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাও এর বাইরে নয়। মার্চের শুরুতে যখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকেই একে একে বন্ধ হতে থাকে বিভিন্ন দেশের স্কুলের দরজাগুলো। ইউনেস্কোর হিসাবমতে সেই থেকে ১৯২টা দেশের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে, স্কুলে যেতে পারছে না।

ইউনিসেফ বলছে বিশ্বে প্রতি ৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১ জন দূরশিক্ষার সুযোগ নিতে পারেনা প্রযুক্তিতে একসেস না থাকার কারণে। সেই হিসাবে ৪৮৩ মিলিয়ন শিক্ষার্থীর জন্য দূরশিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন করলেও একই কারণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের পরিমাণ হতাশাজনক। তবে এতসব মন্দের মধ্যেও কিছু ভাল দিক আছে।

আসলে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষতে একটু সময় লাগে। আমাদের ব্যস্ত জীবনে সেই ফুরসত মিলছিল না। কোভিড-১৯ বাধ্যতামূলকভাবে সেই অবসর এনে দিল।

অন্যদিকে, হিসেবের সূত্রটাও একেক জনের কাছে একেক রকম। যেমন- থমাস আলভা এডিসন প্রায় দশ হাজার বার চেষ্টার পর বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারে সফল হয়েছিলেন। তাঁকে একবার একজন এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে- আপনি কতবার ব্যর্থ হবার পরে সফল হয়েছেন? তিনি বলেছিলেন “আমি একবারও ব্যর্থ হইনি, বরং আমি দশ হাজার বার চেষ্টা করে এমন সব উপায় সম্পর্কে জেনেছি যেগুলো কাজ করে না”।

অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গির একটা ব্যাপার আছে। এডিসনের এই সূত্র প্রয়োগ করেই আমরা আজকে শিক্ষার লাভ-ক্ষতির হিসাবটা করার চেষ্টা করব।

একথা অস্বীকার করার জো নেই যে আইসিটির আবির্ভাব মানুষের জীবনযাত্রায় গতি সঞ্চার করার পাশাপাশি শিক্ষার ইকো-সিস্টেমে সম্ভাবনাময় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে প্রযুক্তির নানারকম প্রয়োগ। বিগত এক দশকে সরকারের এটুআই প্রোগ্রামের প্রচেষ্টায় আমাদের সেবাখাতগুলোতে ডিজিটালাইজেশনের সূত্রপাত হয়েছে। সেইসাথে, শিক্ষায় শিক্ষকদের নেতৃত্বে যে ডিজিটালাইজেশন সম্ভব হয়েছে তার জন্য এটুআই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

সরকার এর আগে শিক্ষকদের আইসিটি দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নানাবিধ উদ্যোগ নিলেও বিরাট সংখ্যক শিক্ষক অনিচ্ছায় কিংবা উৎসাহের অভাবে নিজেদের আইসিটি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি। এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যেও এনিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। কিন্তু এই কোভিড-১৯ এর কারণে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষাবিভাগ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং শিক্ষকদের আগ্রহ ও ব্যবহার দুই-ই বেড়েছে। বেড়েছে শিক্ষকদের দক্ষতাও।

একুশ শতকের পেডাগজিতে টেকনোলজির উপস্থিতি অনস্বীকার্য হলেও আমাদের বিশ শতকের শিক্ষকদের বিরাট একটা অংশ এর বাইরে ছিল। এই প্যান্ডেমিকের কারণে তারাও এখন প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা অর্জন করছে এবং নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এই নতুন দক্ষতাটি আয়ত্ত্ব করছে। শিক্ষকদের মানসিকতা, দক্ষতা এবং অভ্যাসে এই পরিবর্তন বিস্ময়কর! কোভিড না আসলে এই অর্জন পেতে বাংলাদেশকে কমপক্ষে আরও ৫ বছর সময় এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হত।

এই দশকের শুরুতেই অনলাইন এবং ব্লেন্ডেড শিক্ষার শুরু হয় বাংলাদেশে, তবে তার বিস্তার হচ্ছিল বেশ ধীর গতিতে। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু সেখানেও শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ যুক্ত হতে পারেনি। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ও ডিভাইসে একসেস একটা বড় ইস্যু, যেটা এই কোভিড পরিস্থিতিতে আবার সকলের সামনে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে।

মন্দের ভাল দিক হল, সরকারের এই বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ফলে পরীক্ষামূলক যে প্রকল্প নেয়ার দরকার ছিল সেই ধাপ সম্পন্ন হয়েছে এবং এক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা গিয়েছে। এখন দরকার সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং শিক্ষার্থীদের উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।

শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রযুক্তির সমন্বয় নিয়ে পূর্বে যে বিতর্ক তোলা হতো সময়ের প্রয়োজনে তাও এখন আর ধোপে টিকছে না। এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা সকল অংশীজনের মাঝে তৈরি হয়েছে যা শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও গতিশীল করবে। অন্যদিকে, শিক্ষকদের আইসিটিতে প্রাথমিক পরিচিতিপর্ব শেষ, এখন তাঁরা শিখন-শেখানো কার্যক্রমে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং এর নেতিবাচক দিকগুলো এড়াতে সক্ষম হচ্ছেন।

স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষকরা এখন তুলনামূলক কম ব্যস্ত সময় পার করছেন ঘরে থেকে। এই সময়টাতে প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে শিক্ষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ ছিল এবং এখনো আছে, যদিও এই সুযোগ কর্তৃপক্ষ খুব একটা কাজে লাগিয়েছেন- সে কথা বলা যাবে না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এর এক মাঠ-পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে প্রায় অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে দক্ষ নন। খুব সহজেই অনলাইন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই স্কুল বন্ধের সময়ে শিক্ষকদের কিন্তু এই বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করা যেত।

তবে ইদানীং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি দপ্তরগুলো অনলাইনে প্রশিক্ষণের আয়োজন করছেন। শিক্ষা অধিদপ্তরগুলোও এটুআই এর ই-লার্নিং প্লাটফর্ম “মুক্তপাঠ” ব্যবহার করে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষকগণ এখন ঘরে বসে বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পাবেন। যদিও যে হারে এটা হওয়ার সুযোগ ছিল, তার তুলনায় শিক্ষকদের অংশগ্রহণের হার নগণ্য।

শিক্ষকদের নেটওয়ার্কিং এবং রিসোর্স শেয়ারিং প্লাটফর্ম “শিক্ষক বাতায়ন”এ শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক মাধ্যমকে শিক্ষকগণ ক্লাস পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এবং সহকর্মীদের সাথে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনের উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও এখনো সকল শিক্ষক এতে অংশ নেয়নি, তবুও এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।

শিক্ষকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নিজেদের দায়িত্বের জায়গা থেকে নিজেরা সংগঠিত হয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন- এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বার বার অনুশীলনের মাধ্যমে একটা বিষয় যখন অভ্যাসে পরিণত হয়- তখন সেটা করার জন্য আর বাড়তি প্রচেষ্টা কিংবা পরিশ্রমের দরকার হয়না; অনায়াসে তা করা যায়। তবে প্রশ্ন হল এই নতুন অর্জিত দক্ষতা চর্চায় কোভিড পরবর্তী সময়েও আমাদের শিক্ষকদের এই অভ্যাস থাকবে কিনা।

অনলাইনে শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে শিক্ষকদের নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় সহজ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে এবং যোগাযোগের মাধ্যমের কারণেই পরামর্শ ও নির্দেশনা দ্রুত পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উৎস স্কুল বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার অন্যান্য উৎসগুলোর বিস্তার ঘটছে। অনলাইনে এবং বিভিন্ন শিক্ষামূলক ওয়েবসাইটে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ বিচরণ করছে। একইসাথে এটা ডিজিটাল বৈষম্যের বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসছে যা নিয়ে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন।

সংসদ অধিবেশন ছাড়া বাকি সময় সরকারের এই টিভি চ্যানেলটি অলস বসে থাকে। সেই বিবেচনায় এটুআই অনেক আগেই এটাকে শিক্ষাটিভি করার প্রস্তাব দিয়েছিল সরকারকে, দেরিতে হলেও এই কোভিডের কারণে বিষয়টি সম্ভব হল।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে কোভিডের কারণে সারাবিশ্বে ২৪ মিলিয়ন শিশু আর স্কুলে ফিরবে না, যারা ফিরবে তারাও অনেক কিছু ভুলে যাবে ততোদিনে। দেশগুলো বিরাট একটা শিক্ষা ক্ষতির সম্মুখীন হবে, বাল্যবিবাহের শিকার হবে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী, অনেক শিশুই শিশুশ্রমে জড়াতে বাধ্য হবে, মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে, সর্বোপরি পুনরোদ্যমে আগের গতিতে শিক্ষায় ফিরে আসতে বেগ পেতে হবে। অটোপাশ কিছুটা স্বস্তি দিলেও শিক্ষা দিতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক, তাই সেটাকে পুষিয়ে নিতে হবে পরিকল্পিত উপায়ে।

স্কুলকে নানাভাবে দোষারোপ করলেও এই প্রথম অভিভাবকগণ স্কুল এবং শিক্ষকদের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে হাড়ে হাড়ে। শিক্ষা ব্যবস্থা থমকে যাওয়ায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষজন এর দিকে ফিরে তাকিয়ে এর ভাল-মন্দ দিক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, যা পরবর্তীতে শিক্ষব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে তাঁদের সম্পৃক্ততা বাড়াবে বলে আশা করা যায়।

অভিভাবকগণ নিজের সন্তানকে সময় দিতে গিয়ে তাঁদের লেখাপড়ার অবস্থা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পেয়েছেন, অনেকে বিস্মিত হয়েছেন এবং নিজেদের উদাসীনতার খেসারত টের পেয়েছেন। এসব উপলব্ধির জন্য একটা বিরতি দরকার ছিল। প্রতিযোগিতার এই যুগে আমরা আসলে এত বেগে দৌড়াচ্ছিলাম যে কোন দিকে যাচ্ছি আর গন্তব্য কোথায় তা আমরা ভুলতে বসেছিলাম। কোভিডের আগমন যেন ট্রাফিকের লালবাতির মতই আমাদেরকে থামিয়ে দিয়ে একটু ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে সংশোধনের।

নিজেদেরকে আমরা কতোটা শুধরে নিতে পারবো তার ওপর নির্ভর করছে যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে- তা আমরা পুষিয়ে নিতে পারব কিনা। তাই কোভিডকে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত না করে বরং মানবসভ্যতার জন্য শিক্ষার একটা সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষাকর্মী। সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা প্রশাসন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে