নারী নির্যাতন, কোভিড-১৯ ও মানবাধিকার

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২০; সময়: ১২:৩৬ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
নারী নির্যাতন, কোভিড-১৯ ও মানবাধিকার

ফরিদা আখতার : পঁচিশে নভেম্বর থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত ১৬ দিনের কর্মসুচি নিয়ে নারীর বিরুদ্ধ্বে সহিংসতা দূর করার জন্য দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার শুরু হয়েছে। পঁচিশে নভেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত নারী নির্যাতন নির্মূল করার দিবস হিসেবে পালন করেছে বিভিন্ন নারী সংগঠন, তারা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্লোগানে মুখর হয়েছে।

নারী সংগঠনের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এ দিবসকে কেন্দ্র করে এক যৌথ বিবৃতিতে নারী নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরেছে। অধিকার জানাচ্ছে, এ বছর (২০২০) জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯১৯ জন নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে বয়সের নারীর ছিল ৫৬৯ জন, অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন। ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে এমন নারী ও শিশুর সংখ্যা ৩৯ জন। অধিকারের প্রতিবদনে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ এর তুলনায় ২০২০ সালের প্রথম ৯ মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। গত বছর ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৮৩৪ জন নারী ও শিশু। নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু ধর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আরও অনেক ধরণের শারিরীক ও মানসিক, এমনকি সামাজিক নির্যাতন হয়, যা সব সময় পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় না।

কিন্তু ২৫শে নভেম্বরে এই দিবসটি ঘোষণার পেছনে যে ঘটনা রয়েছে তা একটু আলোচন করা দরকার। একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। ২৫ নভেম্বর নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করার দিবস হিসেবে এসেছে রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে। ডোমিনিকান রিপাবলিকের রাফায়েল ট্রুজিলোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে অন্দোলনে আরো অনেকের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তিন বোন প্যাট্রিসিয়া মিরাবেল, মিনার্ভা মিরাবেল এবং মারিয়া টেরেসা মিরাবেল। তাদের তিনজনকে একত্রে মিরাবেল ভগিনী বা মিরাবেল সিসটার্স বলা হয়। এই তিন বোনই শিক্ষিত ছিল এবং তারা দেশে রাজনৈতিক সমস্যা দেখে চুপ থাকেন নি। মারিয়া বলতেন দেশের মানুষ যখন এতো কষ্টে আছে, আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। তারা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছিলেন এবং যারা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নির্যাতিত হতেন তাদের নাম দিয়ে লিফলেট করতেন। তারা অনেকবার জেল খেটেছেন। তবুও তাদের দমানো যায়নি।

মিরাবেল সিসটার্সদের ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ট্রুজিলোর গুন্ডা বাহিনীই তাদের হত্যা করেছিল। এই তিন বোনের আন্দোলন নারী আন্দোলন এবং প্রগতিশীল আন্দোলনে প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। তাদের নৃশংস হত্যাকান্ড তাই সকলকে নাড়া দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে মিরাবেল ভগিনীদের স্মরণে ও তাদের সম্মানে জাতিসংঘের সাধারণ সভা ২৫ নভেম্বরকে নারী নির্যাতন বন্ধের আন্তর্জাতিক দিবস The International Day for the Elimination of Violence against Women হিসেবে ঘোষণা করে। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে একটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, সেটা হচ্ছে নারী নির্যাতন একই সাথে মানবাধিকার লংঘন। মানবাধিকারের সাথে নারী নির্যাতনের বন্ধের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ যদিও এখনো নারী নির্যাতনের বিরোধিতা মূলত নারী সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনও হিসাব কষে দেখে এটা তাদের মানবাধিকারের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা।

এবার বাংলাদেশে কিছু চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু বক্তব্য টেলিভিশন টক শোতে দেখেছি, এর বেশি কোন কার্যকলাপ আমাদের চোখে পড়ে নি। ২৫শে নভেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আমার জানা মতে কোন বক্তব্য দেয়া হয় নি, যদিও এটা তাদের অন্যতম প্রধান কাজ ছিল। বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান (চেয়ারপারসন) নাসিমা বেগম। তিনি নারী হয়েও বিষয়টির প্রতি নজর দিচ্ছেন না, এটা দুঃখজনক। তাছাড়া নারী আন্দোলনের দিক থেকেও বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। নারী নির্যাতনের ঘটনা রাজনীতির বাইরে কিছু নয়।

এ পর্যন্ত যেসব চাঞ্চল্যকর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহারের সরাসরি সম্পর্ক দেখা গেছে। তাই বিচারের দাবিতে এতো সোচ্চার আন্দোলন হলেও ফলাফল হয়েছে শুধু এই যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যু দন্ড করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে অনেক সমালোচিত হয়েছে। আগামি ১৬ দিনে আরও কিছু ঘটবে না এমন কথা হলপ করে কেউ বলতে পারবে না।

নারী নির্যাতন দাবি করে, আন্দোলন করে বন্ধ করার বিষয় নয়, একে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন আখ্যায়িত করে ২৪শে আগস্ট নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যেন ইয়াসমিনের ধর্ষণ, হত্যা ও তার পরবর্তী ঘটনা যেভাবে ঘটেছে তার যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, যার জন্যে সাতজন জনতাকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হতে হয়েছিল। বর্তমানে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব, ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া ভাব এবং সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

এ বছর মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী কোভিড সংক্রমণের কারণে নারী নির্যাতনের ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। কোভিড সংক্রমণ এবং মৃত্যুর দিক থেকে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, কিন্তু এ পর্যন্ত যেসব বিশেষ জরিপ হয়েছে তাতে নারী নির্যাতন বেড়ে গেছে বলে প্রমাণ মিলছে। বাংলাদেশ শুধু নয় বিশ্বের বহু দেশের তথ্য তাই বলছে। সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ কোভিডের প্রথম ধাপ পেরিয়ে এখন দিত্বীয় ধাপের মহামারি চলছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি সহিংসতা বা নারী নির্যাতন বেড়ে যাবার ঘটনাকে জাতি সংঘ নাম দিয়েছে “shadow pandemic ” বা ছায়া মহামারি। ইউএন উইমেন ছায়া মহামারীর বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে কোভিডের সময় লক ডাউন এবং অন্যান্য কারণে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে, যা আগে প্রতি তিন জনে একজনের ক্ষেত্রে হোত। মেয়েরা বাইরে গেলে সেখানেও যৌন হয়রানি এবং অন্যান্য ধরণের নির্যাতন চলছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অনেক দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্যে বরাদ্দকৃত অর্থ কোভিড নিরাময়ের জন্যে ব্যবহার হচ্ছে। ছায়া মহামারী প্রধানতঃ পারিবারিক নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের ওপরই জোর দিচ্ছে, কিন্তু তারা অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না।

বাংলাদেশে কোভিডে নারীরা কম আক্রান্ত হলেও কোভিড প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় লকডাউনে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রথম কোভিড সংক্রমণের ঘোষণার পর সাধারণ ছুটি বা লকডাউন ছিল প্রায় ৬৬ দিন। এই সময় মানুষজন ঘর থেকে বের হতে পারে নি। কর্মক্ষেত্রগুলোও প্রায় বন্ধ ছিল, তারপরেও ধর্ষণের সংখ্যা কমে নি, বরং বেড়েছে। ধরেই নেয়া যায় অধিকারের প্রতিবেদনে যা এসেছে, বাস্তবে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি ঘটেছে। সারা দেশে সাড়া জাগানো ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনাও এই অক্টোবর মাসে অর্থাৎ কোভিড মহামারীর মধ্যেই ঘটেছে। তাছাড়া দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা, পরিবারের সদস্যদের কাজ হারানো, পারিবারিক আয় কমে যাওয়া ইত্যাদী নারীর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।

তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের কথাই ধরা যাক। কোভিডের প্রথম অবস্থায় যখন সারা দেশ স্তব্ধ অবস্থায় ছিল তখন বিজিএমইএ’র সদস্যরা তাদের নিজ নিজ কারখানার শ্রমিকদের মেসেজ পাঠিয়ে ঢাকায় এসে কাজে যোগ দিতে বললো, অন্যথায় তাদের কাজ থাকবে না। তাই এই মেয়েরা বাবা-ভাই বা কয়েকজন শ্রমিক একসাথে মিলে কয়েকশত মেইল হেঁটে ঢাকা আসলো, কিন্তু এসে দেখে আবার ফিরে যেতে বলা হচ্ছে। অনেক কারখানার শ্রমিককে কোন প্রকার সুযোগ না দিয়ে আন্তর্জাতিক অর্ডার নেই বলে চাকুরিচ্যুত করা হল, বকেয়া বেতন দেয়া হল না। তারা যখন দেশে ফিরে যাচ্ছে তখন তাদের শ্বশুর বাড়ি কিংবা বাপের বাড়ি কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এমন কি স্বামী ও ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই পরিসংখ্যান কি কেউ রাখছেন?

শেষ করছি, ২৫ শে নভেম্বরে যখন নারী নির্যাতন বিরোধী শ্লোগান উঠছে , তখন ঢাকায় প্রেস ক্লাবের সামনে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টের অগ্নিকান্ডে আহত ৪৫ জন শ্রমিক ক্ষতিপুরণের দাবীতে ২৯ দিন ধরে আন্দোলন করছেন কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে যাচ্ছে না। তারা প্রশ্ন করছে “আমরা কি মানুষ নই?” শেষ পর্যন্ত একজন শ্রমিক মারা গেছেন বলেও জানা গেছে।

এই নির্যাতন, মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে যদি না দাঁড়াতে পারি, তাহলে আমাদের আন্দোলন কোনদিনই সফল হবে না। আসুন, নারীর প্রতি সকল প্রকার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক নির্যাতনের বিরোধিতা করি।

নারী নির্যাতন আসলেই সরাসরি মানবাধিকার লংঘন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী

 

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে