‘রাষ্ট্র মানেই কাঠগড়া গরাদের খোপ’

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২০; সময়: ৮:৩২ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
‘রাষ্ট্র মানেই কাঠগড়া গরাদের খোপ’

আনিসুল হক : হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস বাদশা নামদার মোগল সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। বইটার শুরুর দিকের ঘটনা। বাদশাহ বাবর তখত রওয়ানে বা ভ্রাম্যমাণ সিংহাসনে অর্ধনিমীলিত নয়নে শুয়ে আছেন। মরুভূমির মধ্যে তাঁদের যাত্রাবিরতি। হঠাৎ দূরে দেখা গেল, ধুলা উঠছে। অশ্ববাহিনী ধেয়ে আসছে। সংবাদবাহকেরা জানাল, ভয়ের কিছু নেই। বাবরের পুত্র হুমায়ুন আসছেন। হুমায়ুনকে পাঠানো হয়েছিল ইব্রাহিম লোদির আগ্রা দুর্গ এবং কোষাগার দখল করতে। হুমায়ুন আসছেন পিতার হাতে কোহিনুর হীরকখণ্ড তুলে দেওয়ার জন্য।

বাবর বললেন, সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। সৈন্যরা অস্ত্র ধারণ করো। আমাকে বর্ম পরিয়ে দাও। নিজের ছেলে আসছে তো কী হয়েছে। ‘সম্রাটের পুত্র থাকে না। ভাই থাকে না।’ বাবর ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। সৈন্যরা প্রস্তুত। হুমায়ুন এলেন। সত্যি সত্যি তিনি তার পিতার হাতে কোহিনুর তুলে দিলেন।

ক্ষমতা কি এ রকমই নিষ্ঠুর? জটিল, কুটিল! তার পিতা নেই, পুত্র নেই, ভাই নেই, বন্ধু নেই? ক্ষমতা কি মানুষকে এতটাই নিঃসঙ্গ করে, নির্বান্ধব করে?

আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন জয়লাভ করেছেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেই চলেছেন, নির্বাচন ভালো হয়নি, ডেমোক্র্যাটরা কারচুপির ভোট দিয়েছে। খবরে প্রকাশ, ‘নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে “অত্যন্ত ভুল” মন্তব্য করার জন্য তিনি সাইবার সিকিউরিটি এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিসা) প্রধান ক্রিস ক্রেবসকে বরখাস্ত করেছেন।’ ক্রিস মন্তব্য করেছিলেন, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা অত্যন্ত সুরক্ষিত। এই কথা বলার ‘অপরাধে’ ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে অপসারণ করে দিলেন।

আর জো বাইডেন ট্রাম্পের কথাবার্তাকে তুলনা করেছেন গোয়েবলসের সঙ্গে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মানুষ হিসেবে পরিচ্ছন্ন নন। নারীকে নিয়ে, বিভিন্ন রেস নিয়ে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ নিয়ে তাঁর অনেক মন্তব্য পলিটিক্যালি ইনকারেক্টই শুধু নয়, ভীষণভাবে আপত্তিকর। আমেরিকানরা সব জানে। তাঁকে সরানোর জন্যও মানুষ মরিয়া হয়ে ভোট দিয়েছেন। আবার এটাও তো সত্য, তাঁকে রাখার জন্যও রিপাবলিকানরা দলে দলে ভোট দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট গতবারের তুলনায় বেড়েওছে। অন্য সব কথা থাক, করোনা অতিমারি নিয়ে তিনি যা যা বলেছেন, সেগুলো একসঙ্গে করে দেখা হলে পুরো একটা সার্কাস বলে মনে হয়। তাহলে কেন এত মানুষ ট্রাম্পকে ভোট দিলেন? আবার আমরা যে এত পছন্দ করি ওবামাকে, তিনি ওসামা বিন লাদেন হত্যার মিশনের পর আগাগোড়া জেনেশুনে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তাঁর প্রশাসন একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন আর কিসিঞ্জার মিলে পাকিস্তানের গণহত্যাকে দিনের পর দিন সমর্থন দিয়ে গেছেন। জর্ডানের মাধ্যমে বিমান পাঠিয়েছেন। সপ্তম নৌবহর রওনা করানো হয়েছিল। নিক্সন এমনকি এ–ও পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘যদি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, করব।’ কারণ কী? অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ হলো ইয়াহিয়া খান ছিলেন নিক্সনের বন্ধুপ্রতিম, ইন্দিরা গান্ধীকে নিক্সন দেখতে পারতেন না, ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিত্বের সামনে নিজে চুপসে যেতেন। এখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ালে চীনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কোন্নয়ন ব্যাহত হতো।

বলতে চাইছি, রাষ্ট্রগুলো কেবল নিজেদের স্বার্থ দেখে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্য, মৈত্রী কেবল নিজের জন্য, অন্যদের জন্য নয়। ক্ষমতাসীনেরা কী ধরনের আচরণ করতে পারেন, কী ধরনের কথাবার্তা বলতে পারেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার একটা কটকটে হলুদ রঙের উদাহরণ।

আমেরিকার সুবিধা হলো, তাদের সিস্টেমটা শক্তপোক্ত। তাদের গণতন্ত্র বহুদিনের, বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। প্রেসিডেন্ট একাই সবকিছু উল্টে দিতে পারবেন না।

২.

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে কিছু বই পড়ার আর কিছু আলোচনা শোনার সুযোগ পাওয়া গেল। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের বিবাদের প্রসঙ্গও এল। বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র—দুজনেরই বিশাল অবদান বাংলা গদ্য তৈরিতে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে দেখতে পারতেন না। তাঁকে তিনি তাচ্ছিল্য করেছেন শিশুপাঠ্য বইয়ের লেখক হিসেবে, স্রেফ একজন অনুবাদক হিসেবে। ঈশ্বরচন্দ্রের সীতার বনবাস বইটি বেরোয় ১৮৬০ সালে, এটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বঙ্কিমচন্দ্র সীতার বনবাস নিয়ে উপহাস করেন।

বিষবৃক্ষ উপন্যাসের চরিত্র সূর্যমুখী একটি চিঠিতে লিখেছে, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’ কথিত আছে, ঈশ্বরচন্দ্র পরীক্ষক ছিলেন বিএ পরীক্ষার, আর বঙ্কিমচন্দ্র সে পরীক্ষায় বাংলায় ফেল করেন।

রণজিৎ গুহ ‘সীতার বনবাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র আর ঈশ্বরচন্দ্রের দ্বন্দ্বের মূলে আসলে ক্ষমতা। ক্ষমতা বিষয়ে দুজনের অবস্থান বা দৃষ্টিভঙ্গি। ‘বাল্মীকি-রামায়ণে বর্ণিত প্রেম ও রাষ্ট্রক্ষমতার সম্বন্ধগত ধারণাটা দ্বান্দ্বিক। কেননা, প্রেম যদি হয় নর–নারীর চরম অন্তরঙ্গতা, তাহলে এই ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্র হবে তার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত ঐতরিকতা, ক্ষমতা যেখানে নিছক যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়, ব্যক্তিসত্তাকে অবজ্ঞা করে, কেবলই শাসনশক্তির মাধ্যমে।’ রণজিৎ গুহ আরও লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রক্ষমতার যান্ত্রিক ব্যবহার যে ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং শেষ পর্যন্ত তাই যে হয়, সেই ক্ষমতাবিনাশের মূল কারণ, তা এই গ্রন্থে (সীতার বনবাস) স্পষ্টই বিবৃত হয়েছে…।’ বঙ্কিমচন্দ্রের রামচন্দ্র ক্ষমতার প্রয়োগ করেছিলেন বাহুবলের মাধ্যমে, নিরপরাধ স্ত্রীকে নির্বাসন দিয়েছিলেন লোকনিন্দার ভয়ে। রণজিৎ গুহের ভাষায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্র এই জটিলতার জালে জড়িয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন।’

রণজিৎ গুহের রচনাসংগ্রহ (আনন্দ) বই প্রথম খণ্ড থেকে আরেকটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। ‘মহাভারতের মেধাজীবী’ প্রবন্ধে দ্রোণ আর দ্রুপদের কাহিনি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছেন রণজিৎ গুহ। দ্রোণ গিয়েছিলেন বাল্যবন্ধু রাজা দ্রুপদের কাছে অর্থাভাবে পড়ে। দ্রোণ রাজাকে সম্বোধন করলেন সখা বলে। রাজা দ্রুপদ হেসে উঠলেন। জানালেন, বাল্যবন্ধুত্বের কারণে রাজাকে সখা বলে সম্বোধন করা যায় না। সৌহার্দ্যের শর্ত হচ্ছে সমতা। ‘তুমি কী চাও? আমি রাজা হলে তোমাকে রাজ্যের ভাগ দেব বলে কথা দিয়েছিলাম? কই, আমার তো মনে পড়ছে না?’ দ্রোণ মনে মনে আশা করেছিলেন, বন্ধু রাজা তাঁকে সাহায্য করবেন, সে আশা পূর্ণ হলো না। রণজিৎ গুহ বলছেন, বন্ধুত্বের কথা না পেড়ে দ্রোণ যদি তাঁর বিশেষজ্ঞজ্ঞান ধনুর্বিদ্যা কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হতো। রণজিৎ গুহ উপসংহার টেনেছেন, ‘ঐতরিকতার কবল থেকে নিষ্কৃতির উপায় নেই মেধাজীবীর। মেধাজীবী বলেই অপরত্বের স্বীকৃতি তাঁর সত্তায় উৎকীর্ণ হয়ে থাকে বিশেষজ্ঞতার আকারে। এই তাঁর অস্তিত্বের দায়। সর্বান্তঃকরণে সেই দায় মেনে নেওয়াই আত্মনির্ভর স্বাধীনতার শর্ত। দ্রোণ তা মেনে নিতে পারেননি। তাই মহাভারতের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর জীবনকাহিনি মেধাজীবীর ট্র্যাজেডি বলে স্মরণীয় হয়ে আছে।’ মানেটা যদি আমি কিছুটা বুঝে থাকি, তাহলে বুদ্ধিজীবী আর নৃপতি সমান নন। বুদ্ধিজীবী রাজার চোখে ‘অপর’ এবং ‘ঐতরিক’। এ কথা স্বীকার করার মধ্যেই আছে বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা।

৩.

শহীদ কাদরীর কবিতা আছে, ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট।’
‘রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে
স্বাধীনতা দিবসের সাঁজোয়া বাহিনী
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে
রেসকোর্সের কাঁটাতার, কারফিউ, ১৪৪ ধারা
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে
ধাবমান খাকি জীপের পিছনে
মন্ত্রীর কালো গাড়ি
কাঠগড়া গরাদের সারি সারি খোপ্,
কাতারে কাতারে রাজবন্দী
রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট॥’

আর কবি আবুল হাসান বলেছিলেন, ‘রাজনীতি এক কালো হরিণের নাম।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

সূত্র : প্রথম আলো

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে