লাল মওলানার উত্তরাধিকার

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২০; সময়: ৭:০১ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
লাল মওলানার উত্তরাধিকার

ফিরোজ আহমেদ : মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প বলতেই মনে আসে ঢাকায় গণহত্যা আর গ্রেফতারের কথা শোনা মাত্র টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষের নিজের বাড়ি ছেড়ে বয়োবৃদ্ধ মওলানা ভাসানীর পায়ে হেঁটে আসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা, যেন তিনি পাকিস্তানীদের হাতে ধরা না পড়েন। যেন মানুষের মনোবল ভেঙে না যায়। তাঁর বয়স তখন আশি থেকে পঁচাশির মাঝে কোন একটা সংখ্যা, কিন্তু মনোবল অটুট।

এই দৃশ্যটা এঁকেছিলেন সৈয়দ ইরফানুল বারী, মওলানার যাত্রাসঙ্গী: ভাসানীকে বাড়িতে না পেয়ে ক্রুদ্ধ পাকিস্তানী সেনারা মওলানার কুড়েঘরটা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, জনগণের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রতিরোধ করতে চাইলে কী শাস্তি হবে, সেটার। হানাদাররা তাঁকে খুঁজতে নেমেছে গ্রেফতার করার জন্য, তাকে ধরা গেলেই পূর্ববাংলার প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতা থাকবেন তাদের হাতের মুঠোয়। বয়োবৃদ্ধ ভাসানী সেই অবস্থা এড়াতেই হাঁটা শুরু করেছিলেন মূহুর্ত দেরি না করে। পথে পথে দগ্ধ গ্রাম, পলায়নপর অসংখ্য মানুষ। একবার দুবার মাওলানার দেখাও পেলো হানাদাররা, কিন্তু অতিচেনা মুখটাকে আলাদা করতে পারলো না আরও বহু গ্রামীণ বৃদ্ধের চেহারার সাথে, সেই তালপাতার টুপি, সে ঢোলা পাঞ্জাবী তো আরও বহু মানুষেরই পরিধেয়। কেউই চিনিয়েও দিলো না, ধরিয়ে দিলো না তাঁকে। পাকিস্তানীরা খুঁজছে মওলানা কোথায়, আর জনতার মাঝে মিশে পায়ে হেঁটে মওলানা চলেছেন আসামের পানে, যে আসামের কৃষকের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য তিনি তার তারুণ্যের এ্কটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন।

পথে এক দরিদ্র চাষী তাকে অনুনয় করলেন একবেলা দাওয়াত নিতে। সামান্য ভাত আর সালুন তিনি আয়োজন করতে পেরেছেন, তাই তৃপ্তির সাথে খেতে খেতে মওলানা তার সঙ্গী ইরফানুল বারীকে বলছেন: সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।

২.
এই হলো সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, উত্তর দিগন্তে যমুনা নদী ধরে ক্রমশঃ মিলিয়ে যেতে থাকা মওলানা ভাসানীর শরীরটি যেন মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপট। মওলানাকে যমুনার ধারেই বিদায় দিয়েছেন, সঙ্গী হতে পারেননি সৈয়দ ইরফানুল বারী, ভারতে তার নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা ছিলো, যেমন যেতে পারেননি মাত্র কয়েকদিন আগে প্রয়াত হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আনোয়ার খান জুনোরাও, কেননা তারা মাওলানার মুখচেনা শিষ্য। নরসিংদীতে তারা পুরোটা সময় জুড়ে এক অকুতোভয় প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ভারতে যাবার আগে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান জুনোদেরকে মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যবহারের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত গাড়িটি। জহির রায়হান নিজেও ভারতে পুরোটা সময়ই ব্যাপক প্রতিকূলতার মাঝে কাটিয়েছিলেন, তার অমর কীর্তি ‘স্টপ জেনোসাইড’ যে বিরুপতার মুখে পড়েছিলো এই ইতিহাসকে চাপা দিতে চাওয়া ব্যক্তিগুলোর দিক থেকে, তার বিবরণ মিলবে মুশতারী শফির স্মৃতিকথায়। জুনোদের সাথেকার আর যারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ খুন হয়েছেন কিংবা আটক হয়েছেন। দেশের বহু অঞ্চলে এরাই গঠন করেছিলেন মুক্তাঞ্চল, পাকিস্তানী বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিয়েই। এই হলো মুক্তিযুদ্ধ নামের আখ্যানটির জটিলতা। কোনো উপন্যাসে আছে এই সংঘাতের ছাপ? কিভাবে এই অধ্যায়কে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র তৈরি করা সম্ভব হবে? জহির রায়হানকে নিয়ে কত কত লেখা, প্রায় সকলেই এড়িয়ে যান তার মতাদর্শিক পরিচয়। মওলানা ভাসানীও যে পুরোটা সময় ভারতে অন্তরীণ ছিলেন, সেই জটিলতাকে ধারণ না করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা অসম্ভব। এই কারণেই মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাসগুলোকে কতিপয়ের ইতিহাস বলে ভ্রম হয়, অসম্পূর্ণ বা ধামাচাপা দেয়া রচনা বলে সেগুলোকে চিনতে কষ্ট হয় না।

৩.
আশ্চর্য শোনালেও সত্যি যে, একজন মাত্র রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে তাদের জীবদ্দশায় শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছিলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এঁকেছিলেন তার ছবি। এই বিষয়টা তাৎপর্যহীন নয়। পূর্ব বাঙলার বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথা তার মতো করে আর কেউ বলেননি, যেন তিনিই ছিলেন সাধারণ জনতার প্রতিচ্ছবি। তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ কৃষকের মাঝ থেকে উঠে আসা এই সংগ্রামী মানুষটি অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রনেতা থেকে শুরু করে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক সকলের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন, সেটা অকারণ নয়। সত্তুর-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর উপদ্রুত এলাকা সফর শেষে ত্রাণের দাবিতে পলটনের ময়দানে মওলানার বক্তৃতা শুনে শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তার বিখ্যাততম একটি কবিতা:

শিল্পী, কবি, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,
খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,
নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানি,
সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কী বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,
যেন মহা-প্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ
সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাড়ি
উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তাঁর বিচূর্ণিত দক্ষিণ বাংলার
শবাকীর্ণ হু-হু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের
দৃশ্যাবলিময়, শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার।

বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার,
অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয়, মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবি,
যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সব
বিক্ষিপ্ত বে-আব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।

৩. মওলানা তার রাজনীতির জীবন শুরু করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন দিয়ে। ব্রিটিশদের কারাগারে দশ মাস কাটিয়েছেন রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই। কংগ্রেসে বেশ কিছুকাল যুক্ত থাকলেও এক সময়ে কংগ্রেসই তাকে ছেড়ে যায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব ছিল জমিদার শ্রেণীর হাতে। জমিদারদের বড় অংশ সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ কৃষকরা তাদের হাতে নির্যাতিত হতেন। ভাসানী এই সাধারণ কৃষকের পক্ষে একের পর এক কর্মসূচি দেওয়ার কারণে কংগ্রেসের সঙ্গে তার স্থায়ী ছাড়াছাড়ি ঘটল ১৯৩৭ সালে। বহু জমিদার তাদের এলাকায় ভাসানীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালানা। এরপর যোগ দেন মুসলিম লীগে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হক, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী মিলে আওয়ামী মুসলিম লিগ গঠন করেন, এবং দলটির নাম থেকে সম্প্রদায়গত পরিচয় বাদ দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য অসাম্প্রদায়িক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সেটাকে গড়ে তোলায় মওলানা একক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

সাধারণ কৃষকের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যেমন কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন, তেমনি আমলা-সামরিকতন্ত্র-জোতদারতন্ত্র আর বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের জাতিগত শোষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি অনায়াসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ গড়ে তুলতে। এই আওয়ামী লীগকে যখন কৃষকের স্বার্থরক্ষায় অগ্রণী মনে হয়নি, এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলটিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে যখন তৎপর দেখা গেল, নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগও ত্যাগ করে তিনি গড়লেন নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ।

৪.
একইভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি নতুনভাবে শোষকের চেহারা নিয়ে আসা নেতৃত্বকেও প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করেননি। ভাষা আন্দোলনে তিনি অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনেও তার ভূমিকা ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম পাকিস্তান বঞ্চিত করা অব্যাহত রাখলে তাদের ‘সালামুআলাইকুম’ জানিয়ে দেওয়া হবে। স্মরণীয় যে, এই ভূখণ্ডের প্রথম কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলায় তার ভূমিকা ছিল অবিকল্পের। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে ওঠা শিল্প শ্রমিকরা তাকে নেতা মানতেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বাধিক সংখ্যক শ্রমিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী, তার নেতৃত্বেই পাটকল, চটকল, বস্ত্র সহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকরা সংগঠিত হয়েছিল। এটাও বলা প্রয়োজন যে, মওলানার অনুসারী ছাত্র সংগঠনের নেতারা অধিকাংশ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ডাকসুসহ দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হতেন।

‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। নূরুল কবীর তার সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘ডিপোজিং অব এ ডিকটেটর’ এ দেখিয়েছেন এই মহান গণঅভ্যুত্থানের কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে থাকলে সেটা মাওলানা ভাসানী। এই গণঅভ্যুত্থান শুধু আইয়ূব খানকে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দেয়নি, বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সূচনাও ঘটিয়েছে।

৫.
ভাসানী মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারত সরকার তাকে প্রায় অন্তরীণ দশায় বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা কম আলোচিত কিন্তু সুদূরপ্রসারী ঘটনা এটি। স্বাধীন বাংলাদেশের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে ভারতের এই মনোভাব বিপুল ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর, অনতিবিলম্বে মওলানা নতুন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গড়ে তোলার দাবি জানান, যারা নতুন দেশের সংবিধান রচনা করবেন। তার সেই দাবি অগ্রাহ্য করা হয় এবং পাকিস্তানের সংবিধান গড়ে তোলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের নিয়েই সংবিধান রচনা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে আসলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনার যে বিকাশ ঘটেছিল, আকাঙ্খার যে বিকাশ ঘটেছিল এই ৯ মাসের সংগ্রামে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বা সংবিধান নির্মাণে সেই চেতনা পরিত্যক্ত হয়। বয়োবৃদ্ধ মওলানা এই আমলেও অন্তরীণ দশার শিকার হন।

৬.
মাওলানা ভাসানী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংগ্রামেও অন্যতম আলোচিত চরিত্র। পত্রিকা প্রকাশকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে মওলানার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি সাপ্তাহিক হককথার প্রকাশ। সরকারের দমন-পীড়ন-লুণ্ঠনের বিস্তারিত বিবরণ, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও অত্যাচার এবং স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠতে থাকায় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়। সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নিষিদ্ধ জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক হককথা। এছাড়া পাকিস্তান আমলে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। মওলানার শেষ গুরুত্বপূর্ণ কীর্তি ছিল ফারাক্কা লংমার্চ। দক্ষিণ এশীয়ার প্রাণ-প্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্র, মানুষের জীবন ও অর্থনীতি রক্ষার আন্দোলনে এর চাইতে বড় সূচনা অন্য কিছু হতে পারে না, ভবিষ্যতে কখনো এই বাস্তুতন্ত্র রক্ষার নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা করা গেলে মাওলানা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

৮.
মওলানা আজকে কতখানি প্রাসঙ্গিক? নূরুল কবীরের লেখা ‘রেড মাওলানা’ কিংবা সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ভাসানীর জীবনী’তে তাকে অমর করে রেখেছেন, এছাড়া আছে সৈয়দ ইরফানুল বারীর অনেকগুলো গ্রন্থ। তার পরও বলা যায়, মওলানার জীবনের বহুক্ষেত্র আজও অনালোচিত, অনালোকিত। মওলানার বিবৃতি ও বক্তৃতার সংকলনে কিংবা তার চীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণে রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে তার যে গভীর দার্শনিক বোধের সাক্ষাত মেলে, তা নিয়ে যথেষ্ট চর্চা আমাদের দেশে নেই, কিংবা বলা যায় উলটো ম্রিয়মান হয়েছে। কৃষকের মুক্তির যে কর্মসূচি মওলানা দিয়েছিলেন, তা এখনকার অর্থনীতির চিন্তায় খুবই অনুপস্থিত, অথচ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজও কৃষক। জাতীয় মুক্তির রাজনীতি তিনি করেছেন, কিন্তু কখনোই উগ্রজাতীয়বাদের খপ্পড়ে পরেননি। বরং আন্তর্জাতিকতা আর বিশ্বমানবতার বোধই তার মাঝে প্রবল। ভাসানীর এই রাজনীতিই তাকে সমকালীন আফ্রো-এশীয়-লাতিন আমেরিকান রাজনীতিতে অন্যতম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও মওলানা ভাসানী প্রেরণা হিসেবে থেকেছেন।

পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাকে এমনকি দেশে ফিরতে বাধা দেয়াতে একবার তাকে লম্বা সময় ইউরোপে কাটাতে হয়েছিল। সেই সময়টি নিয়ে লেখা খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ বইটিও দুইবার নিষিদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানে। দেখা যাচ্ছে জমিদাররা তাকে নিষিদ্ধ করেছেন, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা তাকে নিষিদ্ধ করেছিল, স্বাধীন দেশেও তার পত্রিকা হক কথা নিষিদ্ধ হয়েছে, তিনিও অন্তরীণ দশায় কাটিয়েছেন ভ্গ্নস্বাস্থ্য নিয়ে জীবনের শেষসময়টুকু। বারংবার এই নিষিদ্ধ হওয়া, নির্বাসন কিংবা অন্তরীণ দশা জনগণের মুক্তির জন্য তার আজন্ম প্রতিবাদী অবস্থানেরই ফলাফল।

মাওলানা ভাসানী চিরকাল সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে থাকবেন। বিপ্লবী রাজনীতির সাথে গণমানুষের দূরত্ব ঘুচিয়ে, একইসাথে প্রবলভাবে দেশীয় চরিত্রের কিন্তু আন্তর্জাতিকতা বোধের সংগ্রামের দিশা তিনি দিয়ে গিয়েছেন। প্রয়াণ দিবসে লাল মাওলানার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও রাজনীতিক।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে