ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও মানবাধিকার

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২০; সময়: ৭:৫০ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও মানবাধিকার

ফরিদা আখতার : করোনাভাইরাস পেন্ডেমিক-কেন্দ্রিক নানান ব্যবস্থা নিতে নিতেই এ বছর প্রায় শেষ হতে চলেছে। একদিকে স্বাস্থ্য সেবার ওপর প্রবল চাপ, প্রায় অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো, আক্রান্তদের শনাক্ত করা, চিকিৎসা দেয়া – অন্যদিকে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মহামারী মোকাবেলা করা। এগুলো এখনো চলছে। শীত আসছে। এরই মধ্যে ইউরোপে দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে বলে লক ডাউন এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ আসছে নাকি প্রথম ঢেউ এখনো শেষ হয় নি, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে আগাম সতর্কতা এবং প্রস্তুতি নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বটে, কিন্তু তথ্যের অপ্রতুলতার কারণে বাস্তবতা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য।

করোনাভাইরাসের শুরু থেকে বলা হচ্ছিল এর কোন চিকিৎসা নেই, একমাত্র প্রতিরোধই উপায়। ভ্যাকসিন রোগের চিকিৎসা নয়, এর উদ্দেশ্য শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। তাই ভ্যাকসিন উদ্ভাবন এবং সেটা পৃথিবীর হাজার কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি প্রথম থেকেই আলোচিত হয়ে আসছে। কবে ভ্যাকসিন আসবে, সেটা কোন্‌ কোন্‌ দেশ পাবে এবং সে দেশে কোন্‌ কোন্‌ মানুষকে দেয়া হবে এসবই এখন বিশ্বব্যাপী গবেষণা ও আলোচনার বিষয় হয়ে গেছে। যারা ভ্যাকিসন উৎপাদন করছে তারা নিঃসন্দেহে ব্যবসা করার চিন্তায় আছে। করোনাভাইরাস অনেকের সর্বনাশ ঘটালেও, ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীদের কপাল খুলে দিতে পারে। তারা পৌষমাসের সুখ অনুভব করবে। ভ্যাকসিন উৎপাদন নিয়ে চীন, রাশিয়া, ইউকে, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কারটা বেশি কার্যকর প্রমাণ করা এবং কত আগে ভ্যাকসিন দিতে পারবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন উৎপাদনকারি কোম্পানির তালিকায় বাংলাদেশের একটি কোম্পানিও যুক্ত হয়েছে।

ভ্যাকসিন পাওয়া এবং জনগণের কাছে পৌঁছানোর কাজ নিঃসন্দেহে অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার জন্যে ১ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি হিসাব দিয়েছে বলে পত্র-পত্রিকার খবরে জানা গেছে (Financial Express, 15 October, 2020)। সরকার জনগণকে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেবে বলে পরিকল্পনা করেছে। এই অর্থ অবশ্য সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকেই সংগ্রহ করবে। যদিও সেই ঋণের টাকা বাংলাদেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে। সেটা তোলা হবে অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে। সরকার ঋণ করে এনে ভ্যাকসিন দিলেও এই ভ্যাকসিন সব মানুষ একসাথে পাবে না। ধাপে ধাপে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হবে। ভাগ্যবানরা আগে পাবে, অনেকে হয়তো পাবে না।

তবে ভ্যাকসিন নিয়ে বৈশ্বিক পর্যায়ে যেসব কারবার চলছে সেখানে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের একটি গ্রুপ এক বিবৃতিতে বলেছেন, বিশ্বে কিছু দেশ নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিন কিনে রেখে দিচ্ছেন, তার ফলে অন্যান্য দেশের নাগরিকরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাঁরা বলছেন ভ্যাকসিন পাওয়া, টেস্ট করা, চিকিৎসা পাওয়া, মেডিকেল সাপ্লাই ইত্যাদি নিয়ে জাতিবাদী বা মুনাফাবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। কারণ সবার জন্যে স্বাস্থ্য সেবার যে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে সে অনুযায়ী সবার জন্যে সমান সুযোগ থাকতে হবে। করোনা ভ্যাকসিন সবার পাওয়ার অধিকার আছে।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব দেশ শুধু নিজেদের নাগরিকদের জন্যে ভ্যাকসিন কিনে রাখার চুক্তি করছেন তা বিশ্ব মানবাধিকার মানদণ্ডের বিপরীতে কাজ হচ্ছে। করোনাভাইরাসের এই বিশ্বব্যাপী মহামারী ঠেকাতে হলে সব দেশের সব নাগরিকের ভ্যাকসিন পাওয়ার অধিকার সমান থাকতে হবে। জেনেভা ভিত্তিক Third World Network এর SUNS #9230 ( 11 November 2020) -এ এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে ।

করোনাভাইরাস শুধুমাত্র স্বাস্থ্য বিপর্যয় নয়, এই কথা গত আট মাসের অভিজ্ঞতায় বিশ্ব দেখেছে। বাংলাদেশে আমরাও দেখেছি। মর্মান্তিকভাবে এর সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবাধিকার লংঘনের প্রশ্ন। ব্যক্তি পর্যায়ে যে কোন রোগ দীর্ঘ মেয়াদী এবং কঠিন রোগই অর্থনৈতিক বিপর্যয় আনে। আমরা জানি বাংলাদেশে চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে ৫০ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর দারিদ্র সীমার নীচে চলে যান। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে করোনা সংক্রমণের কারণে এই বছর সারা বিশ্বে ৮.৮ কোটি থেকে ১১.৫ কোটি মানুষ অতি দারিদ্র সীমায় চলে গেছেন। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে ২৬.৫ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে, যা কোভিডের আগের অবস্থার প্রায় দ্বিগুন।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা দেখেছি যে আমাদের অর্থনীতি, সমাজ কাঠামো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ক্রমবর্ধমান ধনি-দরিদ্র ব্যবধান আগেই এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে কোভিডের আক্রমণে সব কিছু নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে দারিদ্র এবং সমাজের অসমতা – তথা মানবাধিকার লংঘন চরমে উঠছে। ভ্যাকসিন উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার যে কার্যকলাপ শুরু হয়েছে তা খুব উদ্বেগজনক। এটা সত্যি যে ভ্যাকসিন যা উৎপাদন হবে তা বিশ্বের সব দেশের সব নাগরিকের জন্যে যথেষ্ট হবে না। অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী (১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০) এ পর্যন্ত বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতায় যে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়েছে, তার ৫১% (বা অধের্কেরও বেশি) মাত্র ১৩% বিশ্ব জনসংখ্যার জন্যে রিজার্ভ করে রাখা হচ্ছে। তার অর্থ হচ্ছে বাকী ৪৯% ভ্যাকসিন থাকবে ৮৩% জনসংখ্যার জন্য। তাহলে তাদের মরা ছাড়া কোন গতি থাকবে না।

কিন্তু পেন্ডেমিকে একটি মেসেজ খুব গুরুত্বপুর্ণ হয়ে গিয়েছে, তা হচ্ছে No one is secure until all of us are secure (সবাই নিরাপদ না হলে কেউ নিরাপদ নয়)। করোনা ভাইরাসের এই বিপ্লবী এবং সমতার রূপ বিশ্বের ধনি দেশ এবং বিভিন্ন দেশের ধনি জনগোষ্ঠিকে একটু বিপদেই ফেলে দিয়েছে। যাদের অর্থ আছে, ভ্যাকসিন যতো দামই হোক তারা নিজেদের রক্ষার জন্যে কিনতে পারবে। কিন্তু এতে তারা কি নিরাপদ হবে? উত্তর হচ্ছে, না। তাই যেসব দেশ তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে ভ্যাকসিন আগেই পাওয়ার জন্যে কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করছেন এবং অন্যান্য দেশ যাদের সেই আর্থিক সংগতি নেই তাদের পেছেন ফেলে রাখছেন, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। এই জাতীবাদী সংকীর্ণ আচরণকে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’ (Vaccine Nationalism) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এর আগে বিশ্বের অনেক নেতৃবৃন্দ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিনকে গ্লোবাল পাব্লিক গুড বা বিশ্বের সবার সম্পদ বলে ঘোষণা দেবার দাবী করেছেন। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড পেন্ডেমিক থেকে রক্ষা পেতে হলে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে হলে, কোভিড চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও আমেরিকা সরাসরি ইতিমধ্যে Pfizer, BioNtech, AstraZeneca GlaxoSmithKline and Sanofi এবং Moderna এর সাথে চুক্তি করেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ নিয়ে সতর্ক করে বলেছেন, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ কোভিড পেন্ডেমিক আরও দীর্ঘায়িত করবে, এর আয়ু কমবে না: “Let me be clear: vaccine nationalism will prolong the pandemic, not shorten it.”। বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে সব দেশে নির্ধারিত সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা। অল্প কিছু দেশের সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা পেন্ডেমিকের সমাধান নয়।

এর বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড ভ্যক্সিনের বিশ্ব ব্যাপী বন্টনের Covax নামের যে স্কীমের ঘোষণা দিয়েছে তাও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। এই উদ্যোগ GAVI (Global Alliance of Vaccines and Immunization) এর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি ফাইনান্সিং স্কীম। বলা বাহুল্য, GAVI সৃষ্টি করেছেন বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, এবং এখন তারাই কোভিডের ভ্যাকসিন পৃথিবীর ৯২টি দেশে দেওয়ার পরিকলনা নিয়েছে। এর পুরো নাম হচ্ছে COVID-19 Vaccines Advance Market Commitment (COVAX AMC)। তারা এ পর্যন্ত প্রায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে। এর সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশ্ব ব্যাংক, বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনসহ বেশ কিছু প্রাইভেট কোম্পানি যুক্ত আছে। বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ভুমিকা নিয়ে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। ভ্যাকসিন নিয়ে তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে তাও ভেবে দেখতে হবে।

ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং তার বিতরণ অসম বৈশ্বিক ক্ষমতার সম্পর্ক, ভ্যাকসিন উৎপাদনের কেপাসিটি এবং ‘ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম’-এর কারণে মানবাধিকারের বিষয় হয়ে উঠেছে। আমাদের আগে, তারপর বাকি থাকলে অন্যেরা, কিম্বা পরে পেলেও পেতে পারো – এই নীতি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত এটা পেন্ডেমিকের সমাধান নয়। এই ভাইরাস মোকাবেলা করতে হলে সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

দরকার ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকতাবাদ, ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতা নয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে