ফাইজারের ভ্যাকসিন বিশ্বের জন্য সুসংবাদ, বাংলাদেশের জন্য নয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২০; সময়: ১১:১১ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
ফাইজারের ভ্যাকসিন বিশ্বের জন্য সুসংবাদ, বাংলাদেশের জন্য নয়

শাখাওয়াত লিটন : যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ঘোষণা দিয়েছে যে তাদের উদ্ভাবিত কোভিডের টিকা ৯০ শতাংশের উপরে কার্যকর, যা ধনী দেশগুলোর জন্য বিরাট এক আশার সঞ্চার করেছে–এটা মহামারির ঘাতক হয়ে উঠবে–এতে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধারের আশায় পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠছে।

কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরীব দেশগুলোর জন্য খুব আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই, এমন কি ভারতের জন্যও না।

আর এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল; দাম আর টিকা সংরক্ষণ-ব্যবস্থা।

যেমন ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়, অথচ বাংলাদেশের এমন কোনো হিমচক্র ব্যবস্থা নেই যাতে এই নিম্ন তাপমাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। ভারতেরও এমন কোনো হিমচক্র ব্যবস্থা নেই।

আর খরচ?

ফাইজার টিকা মূলত ম্যাসেঞ্জার জৈব-প্রযুক্তি ভিত্তিক এমআরএনএ (ম্যাসেঞ্জার রিউবোনেলিক এসিড- যা মানবকোষের ডিএনএ’র সংকেতকে প্রোটিনে রূপান্তর করে শারীরিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে) এর উৎপাদন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। উদাহরণ হিসেবে মডার্নার কথা বলা যায়, এই কোম্পানির টিকার দাম পড়বে ৩৭ ডলার। কাজেই ফাইজারের টিকা এর চেয়ে সস্তা হওয়া কোনো কারণ নেই।

আর ভারতের কাছেও এমআরএনএ ভিত্তিক কোনো টিকা নেই।

‘তারা (ফাইজার) এমন এক সূত্রে কাজ করেছে যা আরও স্থিতিশীল হবে। আর এই মুহুর্তে আমাদের দেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যে, যার মাধ্যমে মাইনাস ৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই টিকা পৌঁছে দেওয়া যাবে,’ স্ক্রলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ড. গগনদীপ কাঙ, তিনি ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক। টিকা নিয়ে গবেষণা কাজের জন্য তিনি সুপরিচিত।

বাংলাদেশের অবস্থাও একই।

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হকও জানান, দেশে বর্তমানে মাইনাস ২ থেকে ৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ‘কিন্তু মাইনাস ৬০ বা ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বজায় রেখেও টিকা সরবরাহ করার কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই।’

আমাদের পুঁজিবাজারেও টিকার সুখবরের কোনো প্রভাব নেই। তাই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের বাজার যখন উর্দ্ধমুখী, তখন বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আজ মঙ্গলবার(১০ নভেম্বর) বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে সূচকের আরও দরপতন হয়েছে।

ফাইজারের ঘোষণা যাইহোক, এতে আরও একবার এই নজির হাজির হল, মহামারি জর্জর এই বিশ্ব মরিয়া হয়ে একটা কোনো টিকার জন্য অপেক্ষা করছে, যা ভাইরাসটির রাশ টেনে ধরবে, কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করবে এবং অর্থনীতিকে বাঁচাবে।

টিকার তীব্র চাহিদার কারণে গত মাস থেকে অনুমোদনের আগেই উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে ফাইজার। গত মাসে দ্য মেইলের রিপোর্ট অনুয়ায়ী, প্রতিষ্ঠিানটি ইতোমধ্যেই তাদের বেলজিয়ামের পুরস কারখানায় ‘কয়েক লাখ ডোজ’ টিকা উৎপাদন করেছে।

প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল যদি সফল হয়, নিয়ামকরা যদি এটিকে নিরাপদ এবং কার্যকর মনে করেন তাহলে তাদের গড়ে তোলা মজুত থেকে বিশ্বব্যাপী দ্রুত টিকা সরবরাহ করা হবে।

মহাকায় এই ওষুধ কোম্পানিটি আশা করছে, চলতি বছরেই তারা প্রায় ১০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করতে পারবে, যার মধ্যে ৪ কোটি ডোজ যাবে যুক্তরাজ্যে–২০২১ সালে কোম্পানিটি এই খর্বকায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে ১৩০ কোটি ডোজে পৌঁছাবে।

দেখেশুনে একে জুয়াই মনে হতে পারে। কিন্তু ফাইজার একা নয় এই বাজিতে।

গত সোমবার থেকে অস্ট্রেলিয়ার একটি কোম্পানিও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা উৎপাদন শুরু করে দিয়েছে।

এবিসি নিউজ জানাচ্ছে, সিএসএল নামের কোম্পানিটি অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ৩ কোটি ডোজ উৎপাদন করবে, যদিও টিকাটির তৃতীয় বা শেষ ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও চলমান রয়েছে।

বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবশ্য এই ট্রায়ালের পুরো ফলাফল জানা যাবে না। আর পরীক্ষার ফলাফল যদি ইতিবাচক হয়ও, তারপরও অস্ট্রেলিয়ার ওষুধ প্রশাসন থেরাপ্যিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (টিজিএ)চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে টিকাটির।

কেন্দ্রীয় সরকার এবং সিএসএলের এই জুয়ার মানেই হল অনুমোদন পাওয়া মাত্রই অস্ট্রেলিয়া এই টিকার দ্রুত বিতরণ শুরু করে দেবে–এবং তারা ধরেই নিয়েছে ৩য় পর্যায়ের ট্রায়াল এবং টিজিএর পরীক্ষায় তারা উর্ত্তীন হবেই।

সিডনি ভিত্তিক বায়ো-এথিসিষ্ট অ্যাঙ্গুস ডসন বলছেন, আগেভাগে উৎপাদন শুরু করাটা একটা ক্যালকুলেটেড রিস্ক ছাড়া আর কিছু নয়।

‘এটা একেবারেই একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার,’ বলেন প্রফেসর ডসন। ‘এটা বড় ধরনের একটা ঝুঁকি, ব্যর্থ হলে কোটি কোটি ডলার অপচয় হবে, কিন্তু সফল হলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বেঁচে যাবে।’

‘কোনো টিকা উৎপাদনে কমপক্ষে ছয় মাস লাগে, তাই এখন উৎপাদন করে যদি মজুদ করে রাখা হয় তাহলে, আমরাই এগিয়ে থাকব।’

এদিকে আমাদের ঘরের কাছের প্রতিবেশী ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, যা বিশ্বের সর্ব বৃহৎ টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের একটি। তারা একটা কোনো টিকা খুঁজে পেতে, এবং উৎপাদন করতে ইতিমধ্যেই ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে।

কোনো চুক্তিতে পৌঁছানোর উন্মাদনায় প্রতিষ্ঠিানটি গত ছয় মাসেই পাঁচটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, এর মধ্যে বড় সমঝোতাটি হয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনকার সঙ্গে।

অ্যাস্ট্রাজেনেকা সেরাম ইনস্টিটিউটকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, যা AZD1222 নামে পরিচিত-এর প্রায় শত কোটি ডোজ উৎপাদনের লাইসেন্স দিয়েছে। ট্রায়াল সফল হলে প্রতিষ্ঠানটি ৪০ কোটি ডোজ এবছরের মধ্যেই সরবরাহ করবে।

গত মাসে ফোর্বস ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেরামের মুখ্য নির্বাহী আদর পুনাওয়াল্লা বলেন,’আমি বিশাল এক ঝুঁকি নিয়েছি। ভ্যাকসিন উৎপাদন রোলার কোস্টার রাইডের মতো, অনেক রকম ফলাফলের সম্ভাবনা আছে, কাজেই চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত শুধু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।’

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 20
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে