যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষ হইয়াও হইল না!

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২০; সময়: ৪:২৯ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : মার্কিন নির্বাচন শেষ। ফলাফল ঘোষণা সবই হয়েছে, তারপরও উৎকণ্ঠার শেষ নাই। কী হতে যাচ্ছে পৃথিবীর এই মহাশক্তিধর দেশটিতে? ট্রাম্প প্রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, এই ফলাফল তিনি মানেন না।

ধারণা করা হচ্ছে, এক-দুইদিনের মধ্যেই ট্রাম্পের কৌশলীরা আদালতমুখী হবেন। ট্রাম্পের এখন শেষ ভরসা আদালত। এর আগেও আদালতের সহায়তায় দ্বিতীয় বুশ ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তখন মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট ৫-৪ ভোটে ফ্লোরিডার ভোট পুনঃগণনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আল গোরকে পরাজিত করেছিল। ফেডারেল সুপ্রীম কোর্টে তখন পাঁচজন রিপাবলিকান মনোনীত বিচারপতি ছিলেন।

তখনকার চেয়ে এখন পরিস্থিতি আরও অনুকূলে ট্রাম্পের; ফেডারেল সুপ্রীম কোর্টে এখনো এই রিপাবলিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে মোট নয়জন বিচারপতির মধ্যে ছয়জনই রিপাবলিকান মনেনীত। এই কারণেই অনুমান করা যায়, ট্রাম্প প্রথম থেকেই কেন ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন!

তবে খারাপ দিক হলো, এবার যদি আবার সেই আল গোরের অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে মজবুত গণতন্ত্রের দাবিদার দেশটির প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে পড়বে। দলীয় বিচার ব্যবস্থার পরিচয়ও প্রকাশিত হবে। অন্নুনত বিশ্বেও দলীয় বিচার ব্যবস্থা জোরালো হবে তখন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য। আবাসন ব্যবসায়ী বাবার সন্তান হিসাবে ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের সাথে সাথে, আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন ট্রাম্প। টেলিভিশন উপস্থাপক হিসাবে জীবনের লম্বা একটা সময় কাটিয়েছেন ট্রাম্প। এনবিসি টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোর প্রধান উপস্থাপক ছিলেন তিনি। ২০০৪ সাল থেকে এই রিয়েলিটি শোর বিষয় ছিল বিজনেস স্কিল। ১৫টি সেশনের এই রিয়েলিটি শো তাকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। এই রিয়েলিটি শোর সাফল্য থেকেই ট্রাম্প রাজনৈতিক জীবনের সন্ধানও শুরু করেন।

ট্রাম্প প্রথমে ডেমোক্র্যাট দলে নাম লেখান। সেখান থেকে চলে যান রিফর্ম পার্টি নামক অখ্যাত একটি দলে। সেখান থেকে রিপাবলিকান, তারপর আবার ডেমোক্র্যাট পার্টি, এবং সবশেষে ২০১২ সালে পুনরায় রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। ২০১২ সালে নিজেকে গভীর রিপাবলিকান প্রমাণের জন্য সেই সময়ের নির্বাচনে ব্যাপক অর্থ সহায়তা করেন; রিপাবলিকান দল তথা সব পর্যায়ের রিপাবলিকান প্রার্থীই তার অর্থ আনুকূল্য পান। এতে ট্রাম্প রাজনৈতিক অঙ্গনে তেমন পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও তার যথেচ্ছ অর্থায়ন তাকে রিপাবলিকান পার্টির গভীরে পৌঁছে দেয়।

এর পরই আসে তার সেই অবিশ্বাস্য অর্জন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হিলারি ক্লিনটন পরাজিত হলেন ট্রাম্পের কাছে, ইলেকট্রোরাল ভোটের ব্যবধানে। হিলারি ক্লিনটনের নাম বহু আগেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল। বিল ক্লিনটনের সেই মনিকা লিউনিস্কির ঘটনায় যখন রিপাবলিকানরা তার বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্টের উদ্যোগ নেয়, তখন হিলারি ক্লিনটন প্রকাশ্যে স্বামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে তার পারিবারিক বিষয় হিসাবে বর্ণনা করার মধ্য দিয়ে আমেরিকার মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী হিলারি ক্লিনটনের পরাজয় সংঘটিত হয়েছিল ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী দর্শনের কাছেই।

ট্রাম্পের ক্ষমতায়নের কালে বিশ্বের বহু ঐক্যমতের বিষয় থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; যেমন: প্যারিস জলবায়ু চুক্তি, বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি— এসব ক্ষেত্রেই ইউরোপের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মত উপেক্ষা করেছেন ট্রাম্প। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধকে ঘোরতর করে ট্রাম্প গোটা বিশ্বকেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছেন।

অভিবাসীদের দেশ আমেরিকা; কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষমতায়ন অভিবাসীদের বিরুদ্ধেই গেছে, বহু প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন ট্রাম্প: মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ কিংবা অবৈধ অভিবাসীদের শিশুদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা কিংবা বৈধ অভিবাসীদের পরিবারের সদস্যদের আগমনের ওপর বাধা-নিষেধ আরোপ অথবা বেশ কিছু মুসলিম দেশ থেকে অভিবাসন নিষিদ্ধ করা— ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। আমেরিকার সুশীল সমাজও বিরোধিতা করেছে এসব জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের; কিন্তু ট্রাম্প তাতে তার উগ্র আমেরিকা ফার্স্ট তত্ত্বের কোনো পরিবর্তন করেননি। গত বছর কংগ্রেস তাকে অপসারণের পক্ষে ভোট দিলেও সিনেটে রিপাবলিকান মেজরিটি থাকায় ইম্পপিচমেন্ট থেকে বেঁচে যান তিনি।

নির্বাচনের বছর শুরু হওয়ার পর, বিশ্বে যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে যায়, তখন চীনের বিরুদ্ধে তার উত্থাপিত অভিযোগ বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই গ্রহণ করেনি। একই সময়ে তিনি নিজ দেশের ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে দেশের মানুষকে মাস্কবিহীন পথ অনুসরণে বাধ্য করেন। যা সত্যিকার অর্থেই দেশটিতে সংক্রমণ বিস্তারের মাত্রা আরও ত্বরান্বিত করে; উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত করোনায় পৃথিবীর প্রধান মৃত্যুভূমির একটি হিসাবে পরিচিত হয়ে আছে।

ট্রাম্পের এসব একগুঁয়ে ভ্রান্ত নীতিই তার নির্বাচনে পরাজয়ের অসংখ্য কারণের কয়েকটি। তার উগ্র হোয়াইট সুপ্রিমেসি মতাদর্শও দেশকে পুরোপুরি দুই ভাগে বিভিক্ত করে ফেলেছে। ফলে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে জো বাইডেন যেমন ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তেমনি ডোনাল্ড ট্রাম্পও সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছেন।

তবে জো বাইডেনকে এগিয়ে দিয়েছেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে। অসাধারণ বক্তা, জ্যামাইকান পিতার সন্তান এই নারী পেশায় একজন আইনজীবী। কমলার পিতা ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক, আর ভারতীয় মা ছিলেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেলের ছাত্রী। ২০০৯ সালে কমলা হ্যারিসের মায়ের মৃত্যু হয়।

ট্রাম্পের পরাজয় আর জো বাইডেনের বিজয় সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে আন্তর্জাতিকভাবে তুরস্কের এরদোয়ান আর ভারতের মোদী সরকারকে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদী প্রায় প্রকাশ্যেই ট্রাম্পকে ভোট দিতে বলেছেন। অন্যদিকে, জো বাইডেন ইতোপূর্বে আসামের এনআরসি, কাশ্মীরের আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল কিংবা ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব আইন— সব বিষয়েই ভারতের সমালোচনা করেছেন। যদিও সরকার পরিবর্তনে মার্কিন নীতির খুব বেশি পরিবর্তন হয় বলা যায় না। বিশেষ করে জো বাইডেনের মতো দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবে অনুমান করা যায়, সৌদি প্রিন্স সালমানের জন্য এক চরম অবস্থা অপেক্ষা করছে। ইয়েমেনের শিশু হত্যা কিংবা সাংবাদিক খাসোগী হত্যার প্রকাশ্য সমালোচনা করেছেন জো বাইডেন। তবে ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় সেই প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি আজও বিতর্কিত হয়ে আছে।

জো বাইডেনের রাজনীতিতে প্রবেশ মাত্র ২৯ বছর বয়সে। তার নির্বাচনী বক্তৃতায় প্রাধান্য পেয়েছে, তিনি একজন গাড়ি বিক্রেতার সন্তান। তিনি পারিবারিকভাবে সম্পদের উত্তরাধিকারী নন।

২.
এবারের নির্বাচনে তো বটেই, বিগত নির্বাচনেও হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করেছিল ভারমন্ট থেকে নির্বাচিত বার্নি স্যান্ডারস, যে নিজেকে একজন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসাবে পরিচিত করেছিলেন। তার এই নতুন সংজ্ঞা পৃথিবীর কাছে একেবারেই নতুন, (তার উদ্যোগেই ডেমোক্র্যাট পার্টির কনভেনশনে মিনিমাম ওয়েজ, বর্তমানের ৯.৭৫ ডলার থেকে ১৫ ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়)। মার্কিন সমাজে সমাজতন্ত্র প্রায় এক নিষিদ্ধ বিষয়। জনকল্যাণের বহু উদাহরণ সামনে নিয়ে এলেও কেউই নিজেকে সমাজতন্ত্রী হিসাবে পরিচিত করে না; এক্ষেত্রে স্যান্ডার্স ছিলেন আলাদা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যতবার জো বাইডেনকে সমাজতন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেছেন, প্রতিবারই বাইডেন তার বিরোধিতা করেছেন। এবারের নির্বাচনে প্রথম দিকে স্যান্ডার্স জো বাইডেনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। তবে স্যান্ডারসের পর পর দু’বার ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থিতা পাওয়ার ঘটনা দলটির বামপন্থী হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম সেই ১৯১৯ সালে। বহু বছর তারা প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছে ০.২৬%, তাও ১৯২৪ সালে। দলটির অনুসারী এখনো টিকে আছে, তাদের একজন বুদ্ধিজীবী নোম চমেস্কি। তিনি প্রকাশ্যে ট্রাম্পের অপসারণের জন্য মত সংগ্রহ করেছেন।

মার্কিন সংবিধান অনুসারে, আগামী ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ রাত ১১টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত ট্রাম্প সকল ক্ষমতার অধিকারী, কাজেই দেখা যাক সেই পর্যন্ত ট্রাম্প তার ক্ষমতা কোথায় এবং কীভাবে প্রয়োগ করেন।

শেষে এই চমৎকারিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করে সমাপ্তি টানি: বাইডেনের বিজয় ঘোষণার পরপরই বিশ্ব আরেকটি সুখবর পেল, সর্ববৃহৎ ঔষধ প্রস্তুতকারী ফাইজার এবং বায়োএনটেক ঘোষণা দিয়েছে তাদের ভ্যাকসিনের সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 1
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে