বাংলাদেশে যেসব প্রভাব পড়তে পারে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২০; সময়: ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
বাংলাদেশে যেসব প্রভাব পড়তে পারে

হুমায়ুন কবির : যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার জয়ের ফলে বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, সে ব্যাপারে আলোচনা করা যায়।

এ জন্য ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে বিশ্ব ব্যবস্থা বা ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ গড়ে উঠেছে তার নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব ব্যবস্থাটা কী, সে বিষয়ে একটু বলি। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে শুরু করে বিশ্বে যতগুলো আন্তর্জাতিক সংঘ আছে তার প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এখনও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় পর্যন্ত সেই নেতৃত্ব বলা যায় নিরবচ্ছিন্নই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সেই বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গা থেকে ক্রমাগত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এলো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভূমিকা কমে গেল, কভিড-১৯ মহামারির মতো অত্যন্ত নিদারুণ সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছটান দিল। এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গা থেকেই মূলত যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ল; যার প্রভাবও দেখা গেল। কভিড-১৯ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হলো না! এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ও নজিরবিহীন।

মনে রাখতে হবে- কেউ যদি নেতৃত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, সে জায়গা ফাঁকা থাকে না। যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এলো চীন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে চীনের প্রেসিডেন্ট সরাসরি ঘোষণা দিয়ে বললেন, এখন বিশ্বায়নে নেতৃত্ব দিতে চায় চীন। এর অর্থ এখন থেকে বিশ্ব ব্যবস্থাটাও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন। আবার চীনের সঙ্গে টানাপোড়েনের কারণে বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘হয় যুক্তরাষ্ট্র’ নয়তো ‘চীন’ এমন একটা বিভাজন রেখা সৃষ্টি হলো। এটা বাংলাদেশ, ভারতসহ উন্নয়ন অর্থনীতিতে এগিয়ে যাওয়া দেশগুলোর জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। একটা বিষয় হচ্ছে- এখন পর্যন্ত সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় দাতা দেশ। সবার চেয়ে বেশি চাঁদা যুক্তরাষ্ট্রই দেয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গা থেকে যখন সরে যায় এবং এর ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, সেটা চট করে পূরণ করা যায় না। যেমন বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হয়, এটা রেগুলেট করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। এখন যুক্তরাষ্ট্র যখন এখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, তখন এই সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ ‘বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি’, সেটা ব্যাহত হয় এবং বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে; যেটা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে। এই যখন অবস্থা, তখন জো বাইডেনের নির্বাচিত হওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ।

জো বাইডেন নির্বাচনী প্রচারের সময়ই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হওয়ামাত্র জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা কার্যক্রম এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনবেন। আশা করা যায়, বিশ্ব সংস্থার যে জায়গাগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সেখানে আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনবেন বাইডেন। ডেমোক্র্যাট পার্টির ফোরামে বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে চীনের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব নিরসন করবেন। তিনি ‘কো-অপারেশন অ্যান্ড কম্পিটিশন’ বা ‘সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা’র নীতি চীনের ক্ষেত্রে নিতে চান। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক।

এখানেই আমি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটিকে টানতে পারি। কারণ চীনের সঙ্গে বিদ্যমান দ্বন্দ্বপূর্ণ অবস্থার নিরসন হলে এবং নিরাপত্তাজনিত দ্বন্দ্বের অবসান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেশি গুরুত্ব পেলে বাংলাদেশ, ভারত বা এ জাতীয় দেশগুলো নানা আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং বিশ্ব বাণিজ্যে অনেক বেশি সুবিধা পাবে। যেমন বারাক ওবামা তার সময়ে আসিয়ানকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এর যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। বিগত দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়ার অর্থনৈতিক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হয়েছে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। যেমন এ অঞ্চল থেকেই চীন প্রবল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। এটিই ওবামার আসিয়ানকে গুরুত্ব দেওয়ার বিশেষত্ব। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে আসিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে গেল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে আসিয়ানকে প্রাধান্য দেবেন। এর অর্থ এটাও দাঁড়ায়, যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস বা ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’তেও নিরাপত্তার বিষয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক কার্যক্রম অধিক গুরুত্ব পাবে। এটাও এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অগ্রসরমান অর্থনৈতিক দেশগুলোর জন্য খুবই ইতিবাচক হবে, যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করবে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রসঙ্গে আসি। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের একটি অংশ বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ কিন্তু এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। এ কারণেই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে যে ব্লু-ইকোনমি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যে বাধাগুলো আছে, তা চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর দুই থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছয় থেকে সাত বিলিয়ন রপ্তানি করে মাত্র। এটা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটা খোলা অর্থনীতি। জো বাইডেন যদি এই খোলা অর্থনীতির দরজা আরও প্রসারিত করেন তবে সুযোগ আরও বাড়বে। আরও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স আয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে একটা উল্লেযোগ্য সংখ্যায় অভিবাসী আছেন অনিয়মিত। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল তাদের জন্য কঠোর। জো বাইডেন আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ অনিয়মিত অভিবাসীকে নিয়মিত করবেন। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিরাও উপকৃত হবেন এবং রেমিট্যান্সেও একটা প্রভাব পড়বে।

সবশেষে আসি রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে। এই সংকট নিয়ে বাংলাদেশের এখন জেরবার অবস্থা। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়, চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে। জো বাইডেন নির্বাচিত হলে যদি যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের অবসান হয় তাহলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে এবং সেখানে ভারতকে পাওয়াও সহজ হবে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে। আগামী ১০ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচন। সেই নির্বাচনের পর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই নির্বাচনে অং সান সু চি আরও বেশি ম্যান্ডেট নিয়ে এলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের যৌথ উদ্যোগ শুরু করা গেলে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হবে।

লেখক: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতি বিশ্নেষক

সূত্র : সমকাল

  • 18
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে