ভালো নেই দেশের মানুষ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২০; সময়: ৭:১৯ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ভালো নেই দেশের মানুষ

ফরিদা আখতার : করোনা সংক্রমণ সব দেশের জন্যেই এক নতুন এবং বহুমাত্রিক সমস্যা। বাংলাদেশ তো বটেই। অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লক্ষ ৬ হাজার ৩৬৪, মৃত্যু ৫৯০৫ জন । প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। এতে আমরা আতংকিত হচ্ছি এবং বিভিন্নভাবে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু একইসাথে অন্যান্য রোগে মৃত্যু থেমে নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, অন্যান্য রোগে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ২৫০০ জন। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ১১.৭ জন প্রতিদিন মারা যাচ্ছে।

করোনা সংক্রামক রোগ। কিন্তু অসংক্রামক রোগ এখনো বিদ্যমান, যা সকল মৃত্যুর ৬৭%, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুই ঘটছে অসংক্রামক রোগে। এবং করোনার ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে অসংক্রামক রোগ যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। বয়স্ক হলে তো কথাই নাই। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে করোনার মৃত্যুর মধ্যেও অসংক্রামক রোগ কারণ হিসেবে রয়ে গেছে।

অসংক্রামক রোগের কারণের মধ্যেও আমাদের জীবনব্যবস্থা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, এমনকি ওষুধ সৃষ্ট কারণ রয়েছে। করোনার ক্ষেত্রে বলা হয়, বিশেষভাবে জীবনযাপন করলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে; আসলে অসংক্রামক রোগের বেলায়ও এ সকল কথা প্রযোজ্য।

স্বাস্থ্যগত বিচারে করোনা বিশ্বব্যাপী মহামারি বা প্যান্ডেমিক আকার ধারণ করার কারণে এবং বিশেষ করে এর বৈশিষ্ট্য ও ধরণ সম্পর্কে নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য দেওয়ার কারণে অনেক বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যা অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক হওয়ার পরও হতে পারেনি। এই বিষয়গুলো অনেকেরই জানা।

করোনা ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়, এই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি, যেমন হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে যে পরামর্শ এলো, তা হচ্ছে মানুষের সমাগম বন্ধ করতে হবে।

যেকোনো কর্মক্ষেত্রই সমাগম ঘটায়। হাট-বাজার না বসলে ব্যবসা বাণিজ্য হয় না, সেখানে জনসমাগম হবেই। বাংলাদেশের মতো দেশে গণপরিবহন জনসমাগমই বটে। এই অবস্থায় মার্চ মাস থেকে শুরু করে প্রথম দু’এক মাস কাজ কর্ম বন্ধ রেখে দেওয়া হয় লকডাউন বা সাধারণ ছুটির নামে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা ঘরে বসে কাজ একমাত্র মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত মানুষই করতে পেরেছেন। সেটা করতে হলেও তার কমপক্ষে একটি ল্যাপটপ বা কম্প্যুটার, ভালো একটি মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট কানেকশান প্রয়োজন হয়েছে। করোনার পরে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন বিক্রি ও ইন্টারনেট (ওয়াই-ফাই) নেওয়ার পরিসংখ্যান নিলেই তা বোঝা যাবে। ল্যাপটপ এবং কম্পুটারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। এগুলো আবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

করোনা মহামারীর এই সময়ে প্রতিদিন আক্রান্তের এবং মৃত্যুর সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি, কিন্তু একইসাথে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিসংখ্যান দেওয়ার দায়িত্ব কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ নেয়নি। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যে তথ্য আসছে, তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গবেষণা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি জানাচ্ছে, ৬৬ দিনের লকডাউনের কারণে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ, কৃষি, শিল্প এবং সেবা খাতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫ কোটি ৯৫ লক্ষ মানুষ দরিদ্রতার মাপে এক ধাপ করে নেমে গেছে। প্রায় ২ কোটি ৫৫ লক্ষ মানুষ অতি দরিদ্র অবস্থায় চলে গেছে।

বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যও প্রায় একই অবস্থা দেখাচ্ছে। তারা বলছে, অতি দরিদ্রের সংখ্যা ১০.৫% থেকে বেড়ে ২০.৫% হয়েছে (জুন, ২০২০ পর্যন্ত)। দারিদ্রতার হার কমিয়ে আনার যে অর্জন, তা আবার বেড়ে গিয়ে ২৯.৪% হয়েছে। এসব ঘটেছে করোনায় আক্রান্ত হবার কারণে নয়, করোনা ঠেকাতে গিয়ে জাতীয় পর্যায়ে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার কারণে; যদিও প্রথম অবস্থায় লকডাউনের কোনো বিকল্প ছিল না। বরং বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন কঠোর করা অবশ্যই প্রয়োজন ছিল; কিন্তু তার পাশাপাশি মানুষের খাদ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে প্রয়োজনীয় সহায়তার পরিকল্পনা ঠিকমতো নেওয়া হয়নি।

বলাই বাহুল্য যে, লকডাউনের কারণে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা হলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিআইডিএস-এর একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৯.২৩% যাদের মাসিক আয় ৫০০০ টাকা ছিল, তাদের আয় ৭৫% কমে গেছে, আর ২৩.৩০% অংশগ্রহণকারী যাদের আয় ১০,০০০ টাকার মধ্যে ছিল তাদের কমেছে ৫০%। অর্থাৎ যাদের আয় আগেই কম ছিল, করোনাকালে তাদের আয় কমেছে বেশি। মরার ওপরই খাড়ার ঘা হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইনফরমাল সেক্টরে কর্মরত শ্রমিক। তাদের কাজ একেবারেই কমে গেছে।

কাজ বা আয় না থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাদের খাদ্য গ্রহণ, পুষ্টি, চিকিৎসা সেবা নেওয়া ইত্যাদি কঠিন হয়ে পড়ে। আইসিডিডিআর,বি’র জরিপে দেখা যাচ্ছে ৭০% পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছেন, আর ১৫% ক্ষুধার্ত থেকেছেন অথবা দিনে তিনবেলা খেতে পারেননি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ঢাকার বাজারে খাদ্যের দামের ওপর একটি মূল্যায়ন করেছে। তাতে দেখা যায়, চাল-ডালের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু ডিম, ব্রয়লার মুরগি ইত্যাদি দাম কমে গেছে। এর কারণ হতে পারে যে, অনেকেই মনে করেছে করোনা ভাইরাস পোল্ট্রি মুরগী থেকে এসেছে।

এবার করোনা মহামারির পাশাপাশি দেশে কয়েকবার বন্যা এবং একটি ঘূর্ণিঝড় খাদ্য উৎপাদনের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছে। লকডাউনের সময় বাজার খুব সীমিত আকারে বসেছে এবং গণপরিবহণ বন্ধ থাকার কারণে কৃষকরা শীতকালীন সবজি বিক্রি করতে পারেননি। তাদেরকে অত্যন্ত কম দামে ফসল ছাড়তে হয়েছে। অন্যদিকে, শহরের ক্রেতাদের বেশি দামে কিনতে হয়েছে। এখানে সরকারের কোনো উদ্যোগ থাকলে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ে উপকৃত হতে পারত।

এরপর বন্যা এবং অসময়ের অতি বৃষ্টির কারণে বন্যার পানি নেমে গেলেও ফসলের জমিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। রাস্তা-ঘাট নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম না মানা, যেখানে সেখানে ঘরবাড়ি, কারখানা স্থাপন করে কৃষক এখন বন্যার চেয়েও বেশি জলাবদ্ধতার কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে। এবার আমন ধানের চাষ করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়েছে। জমি থেকে পানি না নামায় বীজ তলা করতে পারেনি, এমনকি রোপা আমনও লাগাতে পারেনি।

চাকুরি হারানো বা কাজ না থাকায় মানুষ শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, গার্মেন্ট শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিকসহ অনেকে পরিবার নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়েছেন। তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে, ঘর ভাড়া দিতে না পারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলে-মেয়েদের ঢাকায় রাখার প্রয়োজন নেই। অন-লাইন ক্লাস সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। যারা ঢাকা ছেড়েছেন, তারা জেলা শহর, বা উপজেলা ও গ্রামে গিয়ে কাজ যোগাতে পারছেন না। শ্রমিকরা তাদের সঞ্চিত অর্থ খরচ করেছেন, প্রবাসীদের অনেকে সিএনজি চালাতে শুরু করেছেন। এতে এলাকায় সিএনজি বা ব্যাটারি চালিত যানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেড়ে গেছে, ফলে সেখানে আয়ের খুব নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।

কুড়িগ্রাম এলাকার একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ছোট ছোট হোটেলে আগে সকালের নাস্তায় পরোটার সাথে সবজি নিলে ডাল ‘ফ্রি’ দেওয়া হতো, এখন সে ডাল আর ফ্রি নেই। রুটির সাইজও ছোট হয়ে গেছে।

ছোট ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট বন্ধ রেখেছেন কয়েক মাস; এখনো সব দোকান খোলেনি, বা খুললেও বেচা-কেনার অবস্থা ভালো নয়। এর মাধ্যমে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে কর্মচারীর বেতন দেওয়া, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য বিল দেওয়া সম্ভব নয়। আয় হোক বা না হোক, দোকান ভাড়া দিতেই হবে।

অন্যদিকে, ঘর ভাড়াই যাদের আয়ের মূল উৎস, তারাও বিপাকে পড়েছেন। তাদের ভাড়াটেরা ঘর ভাড়া দিতে না পারলে বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। ঢাকা শহরে ‘টু-লেট’-এর সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ বাড়িওয়ালাদের আয়ও কমেছে।

সবচেয়ে কষ্টের দিক হচ্ছে এই কর্মহীনতা, আয় কমে যাওয়ার ফলাফল গিয়ে পড়ে রান্নার হাঁড়ির ওপর। তিন বেলা রান্না সবার ক্ষেত্রে হচ্ছে না, কোনোমতে দু’বেলা খেতে পারলেও তারা খুশি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখার বিষয় হচ্ছে তারা কী খাচ্ছে? সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যের তালিকায় সবজি রাখা যাচ্ছে না। খাদ্যের তালিকায় এখন থাকছে শুধু ভাত, আলু ও ডাল, সাথে মরিচ। মাছ-মাংস তো অনেকের চিন্তার বাইরে।

যদি এই খাদ্যই মানুষ খেতে পারছে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে করোনার ফলে পুষ্টিহীনতাও একটা বড় সমস্যা হয়ে সামনে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ এখনো পুষ্টির বিশ্বের মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে আছে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এবং গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে।

সব মিলিয়ে দেশের মানুষ ভালো নেই। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা লাখের ঘরে, কিন্তু কাজ নেই, আয় নেই, খাদ্য নেই– এই সংখ্যা কোটির ঘরে ঠেকেছে। এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে জরিপ হওয়া প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

শুধু আইসিইউ নয়, মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা চাই।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, উবিনিগ; আহ্বায়ক, তামাক বিরোধী নারী জোট

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 18
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে