ধর্ষণকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলা মারাত্মক ভুল

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২০; সময়: ৮:৩৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ধর্ষণকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলা মারাত্মক ভুল

হেলাল মহিউদ্দীন : ‘ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি’—ধারণাটি ভুল। ইন্টারনেটের হাটুরে ব্লগে, এনজিওদের সাইটে বা ধর্ষণ প্রতিরোধমূলক সামাজিক আন্দোলনের সাইটেও ‘রেপ ইজ আ সোশ্যাল ডিজিজ’ বাক্যটির বারোয়ারি প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু বিদ্বজ্জন কেন এই ভুল করবেন? বাংলায় লেখা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়েও এ ভুল আছে। যাঁদের এ ভুল করা মোটেই উচিত নয়, যেমন: সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান বা নারী ও জেন্ডার অধ্যয়নের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তাঁদেরও এ ভুল করতে দেখা যায়। সাংবাদিকেরা লিখছেন। ছাপছেনও। তাতে ‘সমাজের অসুখ’ ভাবটি বোঝানোর একটি চেষ্টা থাকে। যদিও এই অগভীর ভাবধর্মী (সাবজেক্টিভ) ধারণা নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের অসুখ বা স্খলনের দিকে ইঙ্গিত করে। তাহলেও ধর্ষণ মোটেই ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়। এ ভুলের তাৎক্ষণিক বিপদগুলো ভেবে দেখা দরকার।

ইংরেজি ‘সোশ্যাল ডিজিজ’ হলো সোশ্যাল এপিডেমিওলজি, পাবলিক হেলথ, কমিউনিটি হেলথ, কমিউনিটি মেডিসিন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানসম্মত প্রত্যয়। এ জন্য একে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করার সুযোগই নেই। এ জন্য গোড়াতেই বিদ্যায়তনিক গলদটি স্পষ্ট করা দরকার।

শুনতে অদ্ভুত শোনালেও ‘সামাজিক ব্যাধি’র অর্থ মূলত যৌন আচরণবাহিত রোগ। যৌন রোগ বা যৌনতাজনিত সংক্রামক রোগকে ভদ্রস্থ, নমনীয় ও নির্দোষ ভঙ্গিতে (ইউফেমিজম) বলার সুবিধার জন্য ‘সোশ্যাল ডিজিজ’ শব্দটির উদ্ভব। সেক্সুয়াল ডিজিজ বা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ শব্দগুলো শুনতে-শোনাতে কানে লাগে, রূঢ় শোনায়। ‘সে সিফিলিসের রোগী’ বা ‘গনোরিয়ার রোগী’ বা তার ‘যৌন রোগ’ আছে বললে রোগী সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত-নিগৃহীত ও কলঙ্কিত বোধ করে। মানবিক কারণে যৌন রোগীদের প্রতি প্রাত্যহিক সামাজিক ভীতি-বিদ্বেষ-ঘৃণা (স্টিগমা-বঞ্চনা কাটানোর জন্য) ‘সোশ্যাল ডিজিজ’ শব্দযুগলের আবির্ভাব। গুগলে ইংরেজিতে ‘সোশ্যাল ডিজিজ’ লিখে সার্চ দিলেই তাই উত্তরটি মেলে—সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ’ বা যৌন আচরণবাহিত রোগ। ‘বিহ্যাভিয়ারাল ডিজিজ’ বা ‘আচরণগত বালাই’ শুনেও অনেকে রোগীকে ঘৃণা করতে শুরু করে। ‘সামাজিক রোগ’ কথাটা লেখা ও বলার উদ্দেশ্য, রোগী যেন সে রকম কোনো ঘৃণার শিকার না হন এবং সামাজিকভাবে একঘরে বোধ না করেন বা ভীতি-আতঙ্কে না ভোগেন!

আরেকটি কারণ, কিছু কিছু অসুখ তৈরি হয় সামাজিক কারণে। যেমন ডায়াবেটিস ও স্থূলত্ব। ধনী দেশের নাগরিকেরা ফাস্ট ফুড, মাংস, কোমল পানীয়সহ চর্বি-চিনিযুক্ত খাবারে মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত। তার ওপর অলস। টিভি-ইন্টারনেট-কম্পিউটারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। এক কিলোমিটার পথও হাঁটতে চায় না। গাড়িনির্ভর। ফলে যে স্থুলত্ব রোগ, তা সামাজিক ব্যাধি। কারণ, তা সামগ্রিক সামাজিক বদভ্যাসের কুফল। ডায়াবেটিসের সমস্যাও একই রকম। এসব রোগের মূল চিকিৎসা একটিই—জীবনযাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা (লাইফস্টাইল মেডিসিন)। হাঁটা-চলাফেরা-ব্যায়াম বা শারীরিক সক্রিয়তা না থাকলে, ফাস্ট ফুড বেশি খেলে এই রোগগুলো বাড়ে। অর্থাৎ সমস্যা সামাজিক আচরণে। কিছু কিছু সমাজে দাঁতের ক্ষয় রোগকে সামাজিক ব্যাধি বলা হয়। কারণ, সেসব সমাজে চিনি ও কোমল পানীয়ের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। সমাজবিজ্ঞানীরা দেখলেন ‘আচরণগত রোগ’ (বিহ্যাভিরাল ডিজিজ) শব্দ দুটির মধ্যেও রোগীকে দায়ী করার প্রবণতা থাকে। তা ছাড়া অন্যরা যাঁরা শোনেন, তাঁদের মধ্যেও অস্বস্তি ও মানসিক অভিঘাত তৈরি হয়। সে জন্যই অসুখের নির্দোষকরণের প্রয়োজনে ‘সামাজিক ব্যাধি’ শব্দ ব্যবহার শুরু হয়।

ধর্ষণ কি স্থূলতা বা ডায়াবেটিসের সঙ্গে তুল্য? না হলে এটি সামাজিক ব্যাধি হয় কীভাবে? সামাজিক ব্যাধি তৈরি করে যে আচরণগুলো, সেগুলো অন্যায়-অনৈতিক-অধার্মিক নয়। বেআইনি তো নয়ই, বরং বেশিই সামাজিক। যেমন: পার্টিতে, বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনের হইহুল্লোড়ের সামাজিকতা যত বাড়ে, স্থূলতাবর্ধক খাদ্যগ্রহণও তত বাড়ে। ধর্ষণ তো সামাজিক নয়, অসামাজিক। ধর্ষণের শিকার হওয়া ইচ্ছাধীন নয়, ইচ্ছাবিরুদ্ধ। প্রকাশ্য নয়, গোপন। আনন্দের নয়, বেদনার। আইনি নয়, বেআইনি—এক কথায় অন্যায়-অনৈতিক-অধার্মিক-বেআইনি, সবই।

তা ছাড়া ‘সমাজ’ অনেক বড় ক্যানভাস। যুদ্ধে, জেলখানায়, থানায়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হেফাজতে, পুনর্বাসন কেন্দ্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর একেকটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। শিশুদের যৌন বলাৎকার আরেক ধরনের নির্যাতন। ধনি-দরিদ্র, শিক্ষাসুযোগপ্রাপ্ত-শিক্ষাসুযোগবঞ্চিত, ধর্মপ্রভাবযুক্ত-প্রভাবমুক্ত ইত্যাদি বর্গের ধর্ষণঝুঁকির তারতম্য আছে। গৃহকর্মী, আশ্রিতা নারী, ঘরের বাইরে কর্মজীবী নারী, কৃষিজীবী নারী, আদিবাসী নারী, শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রান্তিক নারী, শহুরে মধ্যবিত্ত নারী, শিক্ষিত নারীর বেলায় ধর্ষণের অপঘাত ভিন্ন ভিন্ন রকম হতে পারে। পুরুষও কি ধর্ষণের শিকার হয় না? ‘সামাজিক ব্যাধি’ হলে ধর্ষণের এত বৈচিত্র্য ও রকমফের থাকত না।

ধর্ষণ একটি ভয়াবহ ‘অপরাধ’। জঘন্য এই অপরাধকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বললে প্রকারান্তরে অপরাধটির লঘূকরণ ও নির্দোষকরণই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হতে পারে সমাজই যেন ধর্ষণের জন্য দায়ী। কিন্তু সমাজে ধর্ষণবিরোধী মানুষের সংখ্যাই বেশি এবং সমাজের সৃষ্টিই হয় ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ যাতে না হয়, সে জন্য; ধর্ষণের মতো অপরাধের দায় নেওয়ার জন্য নয়। সোজা কথা, আইনমতে ধর্ষণ অপরাধ। অপরাধবিজ্ঞানের চোখে ধর্ষণ অপরাধ ও স্খলন (ক্রাইম অ্যান্ড ডেভিয়্যান্স)। সমাজবিজ্ঞানে ধর্ষণের কারণ ‘সামাজিক বিচ্যুতি’ (সোশ্যাল ডিজঅর্গানাইজেশন)।

অর্থাৎ ‘সামাজিক ব্যাধি’ কোনো বিজ্ঞানসম্মত ধারণাই নয়। ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলা হলে বরং ধর্ষণের জন্য নারী দায়ী বা পোশাক দায়ী ধরনের পিতৃতান্ত্রিক আদি ও আদিম অভিযোগই প্রতিষ্ঠা পায়। ২০০৫ সালে সাফোক ইউনিভার্সিটি ল রিভিউ জার্নালে ইলিন সেইডম্যান ও সুজান ভিকার্স ‘দ্য সেকেন্ড ওয়েভ: অ্যান এজেন্ডা ফর দ্য নেক্সট থার্টি ইয়ারস অব ল রিফর্ম’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে এ রকম সিদ্ধান্তেই উপনীত হন যে ধর্ষণই নয়, অযাচিত শারীরিক আগ্রাসনও (আনওয়ান্টেড ফিজিক্যাল অ্যাগ্রেশন) মারাত্মক অপরাধ। এটি প্রায়ই ধর্ষণের পূর্বপর্যায়। অনেকে একে সামাজিক সমস্যা বললে তাঁরা মানলেন না। সেইডম্যান ও ভিকার্স বললেন যে অযাচিত শারীরিক আগ্রাসনকেও অপরাধ ঘোষণা করতে হবে এবং কঠোর নিরোধী আইন তৈরি করতে হবে। সে জন্য তাঁরা আইন সংশোধনও চেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল রিসোর্স সেন্টার অন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ধর্ষণের প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছে। এখনো করে চলেছে। সংগঠনটির সবচেয়ে বড় কাজ ‘রেপ প্রিভেনশন অ্যান্ড রিস্ক রিডাকশন: রিভিউ অব দ্য রিসার্চ লিটারেচার ফর প্র্যাকটিশনার্স’। এই বিশাল তথ্য গবেষণা সংকলনের শিক্ষা এই যে সমাজকে দোষ দেওয়া চলবে না। ধর্ষণকে অপরাধ গণ্য করেই প্রতিরোধমূলক ও আইনগত ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় রাখতে হবে। সারা উলম্যান ধর্ষণপ্রতিরোধী সব পদ্ধতিকে পর্যবেক্ষণ করে ‘আ টেন ইয়ার আপডেট অব রিভিউ অ্যান্ড ক্রিটিক অব এম্পিরিক্যাল স্টাডিজ অব রেপ অ্যাভয়ডেন্স’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে বিস্তারিত উদাহরণসহ দেখিয়েছেন, নৈতিকতা ও ধর্মশিক্ষার এবং মূল্যবোধের শিক্ষাদানের কার্যকারিতা যে একেবারেই নেই তা নয়, তবে খুবই সামান্য। কারণ, ধর্ষক বিকল্প পথ বের করে ফেলে। আইনি রক্ষাকবচ, সুশাসন এবং জননিরাপত্তার নিশ্চয়তার কোনো বিকল্প নেই। আরেকটি শর্ত—কোনো মতবাদ দিয়েই সমস্যাটিকে লঘু করে দেখা যাবে না।

‘ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি’ লেখা এবং বলার মাধ্যমে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে লঘূকরণ করা বন্ধ হোক। এই চিন্তাটিই প্রতিষ্ঠিত হোক যে ‘ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধি’ কখনোই নয়। ধর্ষণ অসামাজিক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

*হেলাল মহিউদ্দীন। অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

সূত্র : প্রথম আলো

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে