উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা শক্তি সঞ্চার করছে

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২০; সময়: ৫:০১ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা শক্তি সঞ্চার করছে

মনোয়ারুল হক : বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ২৮ বছর পর লক্ষ্ণৌ আদালত রায় ঘোষণা করল। ১৫ শতকের এই মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল কংগ্রেস আমলে ১৯৯২ সালে। মামলায় আসামি ছিল বিজেপির প্রথমসারির ৩২ নেতা-কর্মী। লাল কৃষ্ণ আদভানি, উমা ভারতী এর অন্যতম। ১৯৮০ দশকের শুরুতে বিজেপির জন্ম। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর রূপান্তরিত পরিণাম ছিল এই বিজেপি। কংগ্রেস নেতা নরসীমা রাও যখন ক্ষমতায়, কংগ্রেস রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে বাবরি মসজিদ বিতর্কে কার্যকর কোন ভূমিকা নেয় নাই কিংবা স্থাপনাটি রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই।

বাবরী মসজিদ ধ্বংস হলে কংগ্রেস নেতৃত্ব হয়ত ভেবেছিল মুসলিম ভোটাররা আরও বেশী কংগ্রেস নির্ভরশীল হবে অথবা ধর্ম নিরপেক্ষতার ভারতীয় ফেরিওয়ালা কংগ্রেস ধরে নিয়েছিল বিজেপির মাধ্যমে কংগ্রেসের লুকিয়ে রাখা সাম্প্রদায়িকতা বাস্তবায়ন হবে।

বাবরী মসজিদ ধ্বংসের হাত ধরে বিজেপির প্রথম ক্ষমতায়ন হয়। কংগ্রেসের কৌশল ভূল প্রমাণিত হয়। ১৯৪০ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল সেই সময়ের সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব তার মর্মার্থ বুঝতে পারে নাই, যার ফলে ১৯৪৬ সালের মহাদাঙ্গা; পরিণতিতে দেশ ভাগ।

পাকিস্তানের জন্মকালীন রাজনৈতিক দায়ভার পূর্ববঙ্গের বহু রাজনৈতিক নেতার উপর বর্তায়। উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা যোগ হয় যার নাম হয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ । যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে আক্রান্ত হয়ে এই উপমহাদেশে পৃথিবীর প্রথম ধর্মভিত্তিক দেশ হিসেবে জন্ম নেয় পাকিস্তান।

এই দেশটির জন্ম সময়ে প্রধান জনগোষ্ঠী ছিল পূর্ববঙ্গে, যার নামকরণ হয় ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান । মাত্র ২৩ বছরে সেই বাঙ্গালী নেতারা চুড়ান্ত ভাবে বুঝতে পারে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ শোষণের হাতিয়ার। ১৯৬০ এর দশকে শুরু হয় স্বায়ত্ত শাসন আন্দোলন, শেষ হয় পূর্ব পাকিস্তানের বিলুপ্তির মাধ্যমে । নতুন নাম হয় ভূখন্ডের বাংলাদেশ । নতুন নামকরণ, নতুন বাঙালী শাসক, কিন্তু সমাধান হয়না ধর্মের অবস্হানের। দেশটির যাত্রা শুরু হল, জন্ম নিল নতুন সংবিধানের । সংযোজিত হল নতুন দর্শন ধর্মনিরপেক্ষতা। উপমহাদেশের প্রথম সংবিধান এই শব্দটির সাথে পরিচিতি লাভ করল। উপ মহাদেশের মানুষ এর আগে কখনো ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শোনে নাই। ফলে নতুন সংজ্ঞা হলো সকল ধর্মের সাথে সমান ব্যবহার।

শুরুতেই গোল বাধল। কাকরাইলের তাবলীগের মসজিদ রাষ্ট্রীয়ভাবে দান করা হল তাবলীগ গোষ্ঠীর কাছে ১৯৭২ সালে । যে তাবলীগ গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের এক নতুন ধারার ব্যাখ্যা প্রদান শুরু করেছিল পূর্ব থেকেই। তাবলীগ দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠী নারীর শিক্ষা নারীর অধিকার সবকিছুতে এক নতুন মতের আবির্ভাব ঘটায়। তাবলীগ জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার কারণে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা লাভ করেছিল। মুসলিমদের জন্য জন্ম হলো ইসলামী ফাউন্ডেশনের। কিন্তু তখনকার সময় ২০ % অন্য ধর্মাবলম্বীরা কোনা সুবিধা পেল না। নতুন সংজ্ঞার ধর্মনিরপেক্ষতার পথ চলা শুরু হল।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির জন্মকালীন সময়ে নামের সাথে মুসলিম শব্দটি রেখে দলটি মুসলিমদের দল বানিয়েছিল, তেমনি ১৯৫৪ সালের সেই পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনে দলের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ রেখে ২১ দফার ভিত্তিতে যে জোট তৈরী হলো সেখানেও ঊল্লেখ করা হলো কোরান ও সু্ন্নাহর কথা, অথচ সেই রাজনৈতিক দল পরের বছর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম আওয়ামী লীগ হলো। সেই আওয়ামী লীগই মাত্র ১৬ বছর পরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করার পর যে সংবিধান গ্রহণ করল সেখানে জন্ম নিল ধর্মনিরপেক্ষতার।

অথচ এই দর্শনের আভির্ভাব পৃথিবীতে বহু শতাব্দী পূর্বে। বিভিন্ন দেশের এই সংজ্ঞার প্রতি আমরা দৃষ্টি দিতে পারি। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে তাদের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে মার্কিন সিনেটের ধর্ম নিয়ে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রোধ করে। যে পদক্ষেপ ছিল রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করা তথা ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রকাশ।

ইউরোপের অন্য দেশ গুলোর দিকে তাকালে দেখি দীর্ঘ লড়াই এনে দিয়েছে সমাজের রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার উপলব্ধি। কোন দেশেই খুব অল্প সময়ে তার অর্জন সম্ভব হয় নাই। ইউরোপের দেশগুলো বিগত মিলিয়নিয়ামে ধর্ম সংকটে ভুগেছে। তুরস্কের অটেম্যানরা বহুকাল ইউরোপের বহু দেশ দখল করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে।

ইউরোপ ধর্মনিরপেক্ষতার যে ব্যাখ্যা ধারণ করেছিল তা ছিল রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা আর ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাখ্যাই বাবরি মসজিদের ঘটনার জন্মসূত্র। লক্ষ্নৌ রায়ের পূর্বে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট বাবরী মসজিদ বিতর্কে রাম মন্দিরের পক্ষ অবলম্বন করে। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট পারত দুই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমযোতার পথ রচনা করতে। দাবিকৃত জায়গাটি উভয় ধর্মাবলম্বীদের ব্যাবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিলে সমযোতার পথ প্রস্থ হত। কিন্তু তা না করে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের দাবিকৃত জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সেই সুযোগ হাতছাড়া করল।

মজার বিষয় হলো বাবরি মসজিদ রায় প্রদানকারী ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের সেই সময়ের প্রধান বিচারপতি আসামের রঞ্জন গগৈ বর্তমানে ভারতীয় রাজ্যসভায় বিজেপি সদস্য।

ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত ও বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখায় এই দুই দেশের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা শক্তি সঞ্চার করছে। এই দুই দেশে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের পূর্ণ ক্ষমতায়ন হওয়া দরকার। ভারতের আরএসএস এর পূর্ণ ক্ষমতায়ন দরকার, তাহলেই ভারতীয় মানুষ অনুধাবন করবে ধর্ম সমাজ বিভাজনের হাতিয়ার। আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত সম্প্রতি মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগনকে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে বলেছে। ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে চার্চের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 12
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে