বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ’৭৩-এর অধ্যাদেশ পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কি আমরা অক্ষম?

প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২০; সময়: ২:২৬ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত

মনোয়ারুল হক : বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণআন্দোলনের ফসল। ‘৬৯ এর গণআন্দোলনের দাবির বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে যা ‘৭৩ এর অধ্যাদেশ নামেও পরিচিত। দেশে তখন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। চারটি সাধারণ আর দুইটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়।

তখন শিক্ষা পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়নি সেকারণে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সরকারি- প্রধানত সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত, বেসরকারি- এখানে কোন সরকারি অর্থ দেওয়া হয় না এবং আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত। সরাসরি সরকারি অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৪২টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন উল্লেখযোগ্য। প্রায় প্রতিদিন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব ঘটছে। এই ৪২টি সরকারি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাবমুর্তি নানাবিধ কারণে তলানিতে পৌঁছেছে।

নব্বই দশকের শুরুতে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দলীয়করণের যাত্রা নতুন মাত্রায় শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষক ও প্রশাসন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষক কর্মচারী সবাই অবৈধ সুবিধা অর্জনের পন্থা হিসেবে দলবাজিকে একমাত্র মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে। উপাচার্য থেকে নিম্নস্তরের নিয়োগ, সর্বস্তরে দলবাজি ও পরিবারতন্ত্র প্রাধান্য পায়। উপাচার্য ও দলবাজ প্রভাবশালী শিক্ষকরা বহু ক্ষেত্রে তাদের অযোগ্য সন্তানদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হয়নি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভাগের সুপারিশ উপেক্ষিত হয়। কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে দলবাজির কারণে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। বহুকাল যাবত বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা পাইয়ে দেয়া এ সবই করা হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের ঢাল সামনে রেখে। দীর্ঘদিন থেকে চলতে থাকা স্বায়ত্তশাসনের অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহার স্বায়ত্তশাসনের মূল গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে আজ বহুদুরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের নির্বাচন হয় না (নতুন গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সিনেট ব্যবস্থাটিই উঠিয়ে দেয়া হয়েছে)। সিন্ডিকেট গঠিত হয় উপাচার্যের ইচ্ছায়। সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্যের প্যানেল গঠিত হয় না। মাননীয় চ্যান্সেলর উপাচার্য নিয়োগ দেন আমলা ও গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে এর সাথে যুক্ত থাকে সরকারি দলের সন্তুষ্টি ও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ। এখানে উপাচার্যের শিক্ষা, জ্ঞান গরিমা, প্রশাসনিক দক্ষতা খুব একটা নিয়ামক ভুমিকা পালন করে না।

স্বাধীনতা পূর্বকালের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটির শিক্ষক / কর্মচারী নিয়োগ কিংবা তাদের পদোন্নতি কোন কিছুতেই কোন মিল নাই। এমনকি ১৯৭৩ সালের যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় তার প্রত্যেকটির জন্য আলাদা আলাদা আইন তৈরি হয়, সেকারণে একটির সাথে অন্যটির কোন মিল নাই।

সবচেয়ে বেশিবার আলোচনায় এসেছে দেশের দ্বিতীয় পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসনের জন্য। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর স্বাধীনতা বিরোধী ড. আব্দুল বারীকে ১৯৭৭ সালের জুন মাসে উপাচার্য নিয়োগ দেয় তখনকার সামরিক সরকার। এর পরের ঘটনা ১৯৮২ সালের এরশাদ সামরিক শাসন আমলের। বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের শিক্ষক প্রমোশন নীতিমালা তৈরি করে নিজেরাই। যার পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক অধ্যাপক সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে কর্মরত এক হাজারের বেশি কিছু শিক্ষকের মধ্যে ছয়শত শিক্ষক অধ্যাপক। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দেশের সবচেয়ে পুরাতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এত অধ্যাপক সৃষ্টি হয় নাই। ছাত্র শিক্ষক ও অধ্যাপকের অনুপাত হিসাব করলে সবচেয়ে এগিয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বহুবার ঘোষিত পদের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষক নিয়োগের উদাহরণ আছে। অর্থাৎ নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে ২/৩টি পদের কিন্তু নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে হয়ত দ্বিগুণ। এই বিশ্ববিদ্যালয় দলীয় বিবেচনায় ৫ শতাধিকের উপর কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল ২০০৫/০৬ সালে যা বহু আন্দোলনের মাধ্যমে স্থগিত হয়েছিল। কিন্তু সেই একইভাবে দলীয় পরিচিতিতে নিয়োগ এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজশাহী শহরের রাজনৈতিক নেতাদের নিকট আত্মীয়দের কর্মক্ষেত্র হিসাবে সুনাম(!) অর্জন করেছে এই বিদ্যাপীঠ।

১৯৭৭ সালের সামরিক শাসনকালে নিয়োগপ্রাপ্ত ড. আব্দুল বারী তার সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উদ্দেশ্যে কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। মাধমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া সন্তানের ভর্তির জন্য। সাধারণ ক্ষেত্রে যখন ন্যূনতম একটা দ্বিতীয় শ্রেণির বিধান ছিল। ওই কোটা ব্যবস্থ আজও বহাল নানাভাবে।

কথিত আছে বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সরকার উচ্চ আদলতের বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধি করেছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত এক বিধানকে সামনে রেখে। তারই পথ ধরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়। কেবল চাকরীর বয়সসীমা বৃদ্ধি নয় অবসরের জন্য এক অভিনব নিয়ম চালু করা হয়েছে, যার নাম সেশন অবসর। অর্থাৎ ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক যদি তার বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ করে আগাস্ট মাসে, তবে তার অবসরে যাওয়ার দিন ধার্য হবে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন তারিখে। অভিনব এই সেসন অবসরের বিধান পৃথিবীর আর কোন পেশায় আছে বলে মনে হয় না। এটা স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার।

অবসরে যাওয়ার সময় প্রায় সকলকে অধ্যাপকে পরিণত করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হতে প্রধানত ১৬ বছর (পিএইচডি থাকলে ১২ বছর) সময় লাগে। সাথে যে গবেষণার কথা বলা আছে তার সুনির্দ্দিষ্ট কোন মানের কথা বলা নাই। ফলে ছাপার অক্ষরে কোথাও প্রকাশ হলেই তাকে গবেষণাপত্র হিসাবে গণ্য করা হয়। গবেষণাপত্রের মান নির্ধারিত হয় প্রকাশিত জার্নালের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টরের মানের ওপরে। কিন্তু প্রমোশন নীতিমালায় গবেষণাপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের কথা উল্লেখ করা নাই ফলে গবেষণাপত্রটির কোনো মান নির্ধারিত হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘প্রজন্ম কর্মসংস্থানের’ এক অলিখিত বিধান চালু আছে। প্রভাবশালী শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পায়। যাদের অনেকের যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। উপাচার্য তার মেয়ে ও জামাতাকে মেধা তালিকার নীচে থাকা স্বত্বেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অতীতে তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া এই প্রজন্ম সন্তানরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছ। প্রজন্ম বিষয়টি কেবল শিক্ষকদের মধ্যে সীমিত নাই। কর্মচারী, মসজিদের ইমাম প্রজন্ম সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান।

স্বাধীনতার আগে যে নীতিমালায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হতো তা কালো আইন হিসেবে পরিচিত ছিল। আইনটি বিলুপ্ত করে ১৯৭৩ সালে প্রণয়ন করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার নতুন নীতিমালা, যেটি ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ নামে পরিচিত। আমাদের দেশের মুক্তিসংগ্রাম ও তার পটভূমি প্রস্তুত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা ছিলো। সেই বাস্তবতায়, ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে যে পরিবর্তন আনা হয়, তা শতভাগ স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো কি না সে বিতর্ক এড়িয়েও বলা যায়, সেই নতুন আইনগুলো ইতিবাচক ছিলো। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিলো, নতুন রাষ্ট্রে ও সমাজে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হয়ে উঠবে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র এবং অধিকতর গণতান্ত্রিক। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসার পর সংগতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করবে, এবং তা করেছেও।

দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে অধ্যাদেশটি (অ্যাক্ট) বর্তমানে কি অবস্থায় আছে তা পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালের আইনটি বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অনুষদসমূহের ডিন নির্বাচন এবং বিভাগীয় সভাপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে অধ্যাদেশটির কার্যকারিতা থাকলেও উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাদেশটির কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে।

এ প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. আবদুল খালেক তাঁর এক লেখায় বলছেন, ‘….তারপরও মনে রাখতে হবে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মতো মেধা এবং অভিজ্ঞতা অনেক শিক্ষকেরই রয়েছে। বিশেষ করে জীবনে একবার উপাচার্য হওয়ার প্রত্যাশা অভিজ্ঞ শিক্ষকদের থাকতেই পারে। তাদের বাদ দিয়ে যদি একই শিক্ষককে একাধিকবার উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়া হয় শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে বাধ্য। এ ব্যাপারে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে পুনর্নিয়োগের মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সরকারকে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। এ রকম চলতে থাকলে অভিজ্ঞ সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাশ্য বেড়ে যাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।’

১৯৭৩ আইন অনুযায়ী সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের যে বিধি ছিল সে বিধি প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। বিধি অনুযায়ী প্রতি চার বছর পর সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচিত হওয়ার কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে সর্বশেষ উপাচার্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। কাজেই বলা যেতে পারে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচনের ধারাটি রাজশাহী এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অকার্যকর।

২০১২ সালে বাংলা নিউজ ২৪ এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, ঢাবি, রাবি, জাবি এবং চবি’র চার ভিসি অবৈধ। প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয় ‘৭৩ এর আইনের ১১(২) ধারার সুস্পষ্ট লংঘন করে স্রেফ দলীয় বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। রাজশাহীর প্রসঙ্গে বলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপকে নিয়োগ দেয়া হয় ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। নিয়োগপত্রে উল্লেখ করা হয়, সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজনের প্যানেল হতে উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া অথবা পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিয়োগ কার্যকর থাকবে। উনি এখনো ঐ পদে বহাল আছেন।

উল্লেখ্য, ঐ অধ্যাপক ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামীপন্থী ও প্রগতিশীল শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শীর্ষ এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এসব দলীয় উপাচার্যরা নিজেদের আসন ঠিক রাখতে সবসময় সরকারকে খুশি করতে ব্যস্ত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনগুলোকে থামিয়ে দিচ্ছেন দলীয় ছাত্রসংগঠনের ক্যাডারদের ব্যবহার করে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারেও অনাগ্রহ তাদের। শিক্ষকরা লাল, নীল, সাদা গোলাপি, বেগুনি নানা রংয়ে বিভক্ত। অন্ধ দলবাজির অভিযোগ প্রায় সকল শিক্ষকের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার পরপরই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি ধারা চুটিয়ে রাজনীতি করে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যত প্রকার নির্বাচন আছে সেগুলোতে অংশগ্রহণ করে। কালক্রমে ভিসি হওয়ার একটি অলিখিত রুল তৈরি হয়েছে যে, যারা ভিসি হওয়ার দৌড়ে থাকবে তাদেরকে অন্তত দুইবার শিক্ষক সমিতির সভাপতি সেক্রেটারি হতে হবে। ৭৩ এর অধ্যাদেশের অধীনে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের মূল এখানেই।

গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ১৪৬তম সভায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি-পদোন্নয়ন বিষয়ে এক অভিন্ন নীতিমালা গৃহীত হয়। এ নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সমান নয় এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক ধরনের বৈষম্য বিরাজমান। এই বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। যে কোন ধরনের বৈষম্য অবশ্যই দুর করতে হবে কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। এই আইনের অধীনে থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্দিষ্ট বাস্তবতায় নিজেদের মতো করে নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেট ও সিনেটের। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈষম্য দুর করার অভিন্ন নীতিমালা ১৯৭৩ সালের আইনের মূল চেতনা পরিপন্থী কিনা ভেবে দেখতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন যেন মুখোমুখি না দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প স্বায়ত্তশাসনের খণ্ডিত বাস্তবায়ন নয় বরং ‘৭৩ এর এ্যাক্টের পুর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চলমান অব্যবস্থা ও সংকট দুর করতে পারে।

*লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে