অপরাধ এবং অপরাধের মাত্রা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৪, ২০২০; সময়: ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
অপরাধ এবং অপরাধের মাত্রা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনাটি এ দেশের সব মানুষকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমাদের দেশে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না তা নয়, খবরের কাগজ খুললেই আমরা এ রকম দু-চারটি ঘটনার খবর জানতে পারি। একসময় বিকৃত মানসিকতার মানুষ গোপনে এ ধরনের কাজ করার চেষ্টা করত, এখন সেটি আর তাদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বেশ কয়েকজন মিলে একে অপরকে সাহায্য করে একটা সামাজিক ঘটনার মতো সবাই মিলে ধর্ষণ করে, অপরাধবোধ দূরে থাকুক, লজ্জা পর্যন্ত নেই।

কাজেই সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনাটি আরো একটি ধর্ষণের ঘটনা হিসেবে আমাদের একটা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে পারত। কিন্তু ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সেটি একটি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। তার কারণটি আমরা মোটামুটিভাবে অনুমান করতে পারি, ঘটনাটি এতই হৃদয়বিদারক যে, সেটি নতুন করে আলোচনা করার মতো সাহস আমার নেই। যে বিষয়গুলো অন্য সবার মতো আমাকেও যন্ত্রণা দিচ্ছে, সেটি হচ্ছে যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তারা সরকারদলীয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে এসেছি এবং ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে খারাপ রূপটি দেখে অভ্যস্ত, তারা সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বুঝে যাই। আমরা জানি, তারা নিশ্চয়ই একজন গডফাদারের ছায়ায় নিরাপদে থাকে, তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে এবং পুলিশের সাধ্য নেই তাদের স্পর্শ করে। সে জন্য প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষিতা মেয়েটির স্বামী পুলিশ কমিশনারকে ফোন করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এমনকি এমসি কলেজ হোস্টেল পর্যন্ত পুলিশ পৌঁছে যাওয়ার পরও তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতির বাহানা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেনি, ধর্ষকদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এরা হচ্ছে সেই পুলিশ, যারা নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কা না করে চোখের পলকে একজন মানুষকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে। এই ছেলেগুলো এতই ক্ষমতাশালী যে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়েও তাদের ভেতর কোনো ভয়ডর নেই, তরুণ-তরুণীটির গাড়িটা পর্যন্ত রেখে দিয়েছে! শুধু তা-ই নয়, যখন এই তরুণ-তরুণীটি কান্নায় ভেঙে পড়ে একজনের কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করছেন, তখন তাদের টেলিফোনে ফোন করে চলে যেতে বলেছে। তাদের কাজকর্মে অপরাধীর কোনো মানসিকতা নেই, এই এলাকার হর্তাকর্তা বিধাতার একটি মানসিকতা আছে। তারা একবারও ভাবেনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিশ্চয়ই আগে কখনো নেয়া হয়নি।

আমি একেবারে এক শ ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এ রকম ঘটনা এই ছেলেগুলো প্রথমবার ঘটায়নি, তারা অনেকবার ঘটিয়েছে। এবারেও ঘটনাটি সবার চোখের আড়ালে থেকে যেতে পারত, শুধু ঘটনাক্রমে এটি জানাজানি হয়েছে এবং ছেলেগুলোকে প্রথমবারের মতো মাথা ন্যাড়া করে দাড়ি কামিয়ে এদিকে-সেদিকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তারপরও তারা ছাত্রলীগের অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, কীভাবে এই ফাঁড়া কাটিয়ে উদ্ধার পাওয়া যায়, তার চেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের বড় নেতারা বলছেন, তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়, তারা ছাত্রদল থেকে এসেছে। তারা এখনো জানে না, ছাত্রদল থেকে আসতে হয় না, ছাত্রলীগের ছেলেরা এ ধরনের অপরাধ করতে পারে।

আমি আমার নিজের চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেয়ার পর ধর্ষকদের ছেড়ে দিতে দেখেছি। যদিও আমি কখনোই বুঝতে পারিনি, যে অপরাধের ঘটনা রাষ্ট্রীয় আইনে হওয়ার কথা, সেটি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে করা হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে ছাত্রনেতা পুষতে দেখেছি, তাদের দিয়ে শিক্ষকদের শায়েস্তা করতে দেখেছি। কাজেই সিলেটের এমসি কলেজের অমানুষদের হিংস্র দানবে পরিণত করার পেছনে নিশ্চয়ই গডফাদাররা আছে এবং তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। চুল-দাড়ি কামিয়ে পালিয়ে যাওয়া এই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের শূন্যস্থান দ্রুত অন্যরা পূরণ করে ফেলবে।

আমরা সিলেটের এমসি কলেজের এই অবিশ্বাস্য নৃশংসতা দেখে স্তম্ভিত হয়েছি, এই একই রকম নৃশংসতা আরো কতবার কত জায়গায় ঘটেছে, সেটা কি আমরা জানি? এ রকম ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং আমরা জেনেও না জানার ভান করতে থাকব। পুলিশ এবং কর্তৃপক্ষ তাদের দেখেশুনে রাখবে, শুধু জানাজানি হয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং কিছুদিন পার হওয়ার পর আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকবে, এটাই কি একমাত্র সমাধান?

আমরা প্রায় নিয়মিতভাবে দেশ সম্পর্কে ভালো কথা শুনতে পাই। পদ্মা ব্রিজ প্রায় করে ফেলছি, মেট্রোরেল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ব্যাংকে রেমিটেন্স হিসেবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জমা হচ্ছে, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার খুবই কম ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা যদি ধর্ষিতা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, ‘এই দেখ মা, দেশ কত এগিয়ে যাচ্ছে। সেই তুলনায় তোমার মতো একজন মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনাটি খুবই ক্ষুদ্র একটি ঘটনা! এ ঘটনার কথা ভুলে যাও, মা!’

মেয়েটি কি কোনো সান্ত্বনা পাবে? এই দেশটি কি এই মেয়েটিরও দেশ নয়?

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।

  • 10
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে