সমঝোতা, দায়হীনতা, বিচারহীনতা: দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিকতা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০; সময়: ২:০৩ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
সমঝোতা, দায়হীনতা, বিচারহীনতা: দুর্বৃত্তায়নের ধারাবাহিকতা

দ্বোহা চৌধুরী : যখনই কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে, তখনই কিছু অদৃশ্য চক্র নজরে আসে। প্রথমেই চেষ্টা হয় সমঝোতার। সে ঘটনা সামান্য কথা-কাটাকাটি থেকে শুরু করে হত্যা কিংবা ধর্ষণের মতো অপরাধ হলেও— প্রথম ধাপ সমঝোতা চেষ্টা।

সমঝোতা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরের পর্ব, দায়হীনতার প্রবণতা। যেমন- অপরাধীরা ‘হায়েনা’, মানুষ নয়; অপরাধীরা ‘বহিরাগত’, আমাদের নয়।

এরপর ঘটনার স্টিয়ারিং নিজের হাতে তুলে নেন। বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় অপরাধীদের। তারপর আদালতের মারপ্যাঁচে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি — ফলাফল, চক্রের শেষ ধাপ- বিচারহীনতা।

দুর্বৃত্তায়নের এই চক্র যেন কখনো ভাঙার নয়। আর তাই গত শুক্রবার রাতে সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ ছাত্রাবাসে ঘটে যাওয়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায়ও এ চক্রের পুনরাবৃত্তি শুরু হয়েছে।

প্রথমেই চেষ্টা হয়েছিল সমঝোতার। কিন্তু, সেই চেষ্টা সফল না হওয়ায় এখন চলছে দায়হীনতা পর্যায়। ক্রমান্বয়ে তা বিচারহীনতায় পরিণত হবে কিনা, নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এ অপরাধে যারা অভিযুক্ত তাদের পারিবারিক পরিচয়ের আগে উঠে আসছে রাজনৈতিক পরিচয়। জানা গেছে, তারা ছাত্রলীগের কর্মী। অবশ্য তাদের অনুসারীর বহর দেখে নেতা বললেও ভুল হবে না।

তবে, নেতারও নেতা থাকেন। তাদেরও আছেন। তারা সবাই সিলেটের টিলাগড় কেন্দ্রিক আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনজীবী রণজিৎ সরকারের অনুসারী।

অবশ্য অভিযুক্ত ছয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর মতো রণজিৎ সরকারেরও বর্তমানে কোনো পদবী নেই। আছে সদ্য সাবেক পদবী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক।

নগরীর টিলাগড় কেন্দ্রিক আধিপত্য কেবলমাত্র মুরারিচাঁদ কলেজের কারণে নয় বরং সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ— সব মিলিয়েই। আর এ আধিপত্যের লড়াইয়ে রণজিৎ সরকারের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও আছেন।

তার বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী আজাদুর রহমান আজাদই প্রতিপক্ষ। আজাদও সাবেক পদবীধারী নেতা। সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক।

বছর চারেক আগেও ‘আজাদ-রণজিৎ পরিষদ’ সিলেটের পরিচিত এক নাম ছিল। অবশ্য এখনো তারা দাবি করেন তাদের বন্ধুতা অটুট। তবে, তাদের অনুসারীদের প্রকাশ্য শত্রুতায় নির্মমভাবে প্রাণ গেছে অন্তত চার জন ছাত্রলীগ কর্মীর, আহত হয়েছেন অজস্র।

কর্তৃত্ব এবং তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ (রণজিৎ সরকারের স্বপ্ন সংসদ সদস্য হওয়া এবং আজাদের স্বপ্ন সিলেট সিটি মেয়র হওয়া) টিকিয়ে রাখতে নিজেরা পদবীধারী না হয়েও আওয়ামী লীগ নেতা, এবং তাদের অনুসারীরা আনুষ্ঠানিক পদবীধারী না হয়েও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী।

এ অনুগত অনুসারীদের টিকিয়ে রাখতে তাদের দুর্বৃত্তায়নকে মদদ দিতে প্রথমেই যে উদ্যোগ নেন এসকল নেতারা- তা হলো সমঝোতার।

ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে সন্ধ্যার পর। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে। অবশ্য কলেজ অধ্যক্ষ বলছেন পুলিশ তার কাছ থেকে ছাত্রাবাসে ঢোকার অনুমতি নেয় ৮টার দিকে। আর ধর্ষণের শিকার তরুণীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রাত ১২টায়।

ঘটনা যদি ৮টার আগের হয়, তাহলে রাত ১২টা পর্যন্ত কী হচ্ছিল? কেন পুলিশ ৮টায় প্রবেশের অনুমতি নিয়ে পরে সবাইকে জানাচ্ছে যে, রাত ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়েছিল? কেন ধর্ষণের শিকার তরুণীর দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে কালক্ষেপণ করা হয়েছে? অধ্যক্ষ রাত ৮টায় ঘটনা জানার পরও রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে গেলেন কেন?

পুলিশের পরিদর্শক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে দেখা যায়নি অথবা দিতে চাননি।

কলেজের অনেক শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, এই সময়ে পুলিশ তার নিয়মিত কাজ করেনি, বরং সমঝোতার চেষ্টা করেছে। আর এর পেছনে ছিলেন অভিযুক্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা রাজনৈতিক নেতারা।

অবশ্য বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় ও জড়িতদের পরিচয় প্রকাশ্যে বের হয়ে আসায় দুর্বৃত্তায়নের প্রথম ধাপ সমঝোতা ব্যর্থ হয়। ভিকটিমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মামলা করা হয়। শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ।

অভিযুক্ত প্রত্যেকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের কাভার ছবি, প্রোফাইল ছবি কিংবা টাইমলাইনের ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছিল তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক, ছাত্রলীগ কর্মী এবং রণজিৎ সরকারের অনুসারী।

শুক্রবার রাত কিংবা শনিবার সকাল থেকে গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি না থাকা আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকার বিকেল ৩টা ৪৪ মিনিটে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে ঘটনাটির প্রতিবাদ জানান।

সংঘবদ্ধ ধর্ষণের এ ঘটনা পাকিস্তানি হায়েনাদের কর্মকাণ্ডকে হার মানিয়েছে উল্লেখ করে তিনি অভিযুক্তদের হায়েনার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং অভিযুক্তদের দল-গোত্র-দেশ কিংবা মানুষ পরিচয় থাকতে পারে না বলে জানিয়েছেন।

হ্যাঁ, ‘দল-গোত্র’ থাকতে পারে না; অর্থাৎ দল (আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ), গোত্র (রাজনৈতিক গ্রুপ) থাকতে পারে না।

এ ব্যাপারে রণজিৎ সরকারের সঙ্গে আলাপকালে জানান, তিনি ২০ বছর আগেই ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়ে আইন পেশায় যোগ দিয়েছেন। তার ছেলের বয়সী এসব কর্মীদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই এবং এই গ্রুপিং-দ্বন্দ্ব সবই মিডিয়ার সৃষ্টি। কেবলমাত্র টিলাগড়ে কিছু ঘটলেই তাকে এবং তার বন্ধু কাউন্সিলর আজাদুর রহমানকে দোষারোপ করা হয়।

সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্তদের বখাটে হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জানান, ছাত্রলীগের কমিটি না থাকাতেই অভিভাবকত্বহীন অবস্থায় সব ধরনের মানুষ এসে নিজেকে ছাত্রলীগ দাবি করছে।

তিনি বলেন, ‘ছবি তো যে কেউ যে কারো সঙ্গে তুলতে পারে, উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এতে তো এটা প্রমাণিত হয় না যে, এসব ধর্ষকরা আমার অনুসারী। ওরা তো ছাত্রলীগেরও না, কারণ তাদের আনুষ্ঠানিক সদস্যপদও নেই।’

বিষয়টি নিয়ে আজাদুর রহমান আজাদের সঙ্গে আর বিশদ আলোচনা করা যায়নি। তিনি ঘটনাকে ন্যক্কারজনক বলে জানান, কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হওয়ার পর শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা করাতে কয়েকদিন ধরে ঢাকাতেই অবস্থান করছেন।

অবশ্য দায়হীনতার এ মিছিলে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। সবাই একই কথা বলছেন— ধর্ষণকারীরা আমাদের না।

অতএব, দায়হীনতার ধাপও শেষ হলো। প্রধান আসামিসহ দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

দেখার পালা এই যে, আওয়ামী লীগ নেতা রণজিৎ সরকার সিলেট আদালতের আইনজীবী হিসেবে পেশাগত ‘মজবুরি’র দোহাই দিয়ে আগের অসংখ্য ঘটনার মতো এ ঘটনাতেও অভিযুক্তদের আইনজীবী হিসেবে আদালতে দাঁড়ান কিনা।

দ্বোহা চৌধুরী: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার

  • 8
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে