স্বাধীন জনপ্রশাসন কেন দরকার

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০; সময়: ৭:৫৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত

মনোয়ারুল হক : দুর্গা শক্তি নাগপাল। জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের শহর আগ্রায়। আইএএস (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) ২০১০ সালের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এবং ২০১১-তে চাকরিতে যোগদান করা অফিসার। এই আইএএস অফিসার তার সাহস ও দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠার কারণে ভারতীয় জনগণের কাছে সততা ও সাহসিকতার প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।

২০১৩ সালের ঘটনা। ভারতের কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এনডিএ (NDA) কোয়ালিশন সরকার। উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টির মুলায়েম সিং যাদব জয়লাভ করে তার ছেলে অখিলেশ যাদবকে মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করেন।

দুর্গা শক্তি নাগপাল তখন উত্তর প্রদেশের কানপুরে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তার প্রথম সাড়া জাগানো ঘটনা ওই জেলায় অবৈধ বালু উত্তোলনকারী মাফিয়াদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় ঘটনা, একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দেয়াল সংলগ্ন সরকারি জায়গা অবৈধভাবে দেয়াল তুলে দখলে নেওয়ার চেষ্টায় বাধা দেওয়া।

২০০৯ ও ২০১১ সালে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট এক আদেশে নির্দেশ প্রদান করেন, এর পর যথাযথ অনুমতি ব্যাতিরেকে যদি মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরূদুয়ারা কিংবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়, তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা জানামাত্র বেআইনি কাজ বন্ধ করবেন এবং তাতে যদি কোনো ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তবু তা বন্ধ করতে হবে।

দ্বিতীয় ঘটনার পরে দুর্গা শক্তি নাগপালকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব সাময়িক বরখাস্ত করেন। অখিলেশ যাদবের রাজনৈতিক দলের অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের সঙ্গে জড়িত মুসলিম ধর্মালম্বী নেতা-কর্মীরা এই ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত করার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, গ্রামের মানুষও মূল ঘটনার ব্যাপারে অবহিত ছিলেন না।

 

 

দুর্গা শক্তি নাগপাল

 

 

দুর্গা শক্তির মতো ২৯ বছর বয়সী একজন নবীন অফিসার, যার চাকরির বয়স মাত্র দু’বছর, কিন্তু সাহসিকতার জন্য সমগ্র ভারতের গণমাধ্যম তার পাশে দাঁড়ায়। ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে।

১৩ জুলাই ২০১৩, এলাহাবাদ হাইকোর্টে একজন আইনজীবী জনস্বার্থে (Public interest litigation) এক মামলা দায়ের করেন এই মর্মে যে, এ ধরনের বরখাস্তের আদেশ রাষ্ট্রের কর্মচারীদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধার সৃষ্টি করবে। কিন্তু হাইকোর্ট মামলাটি জনস্বার্থে নয় বলে খারিজ করে দেন।

এরপর ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টের আরেক আইনজীবী জনস্বার্থে মামলা রুজু করে একইদিনে সুপ্রীমকোর্টের তিনটি বেঞ্চে মামলাটি উপস্থাপিত হলে প্রথম দুটি আদালত মামলাটি শুনতে অস্বীকৃতি জানালেও তৃতীয় বেঞ্চের একজন মুসলিম বিচারপতির যৌথ বেঞ্চ দুর্গা শক্তিকে মামলা করার উপদেশ দিয়ে আদেশ প্রদান করেন।

উত্তর প্রদেশের সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল, সর্বভারতীয় গণমাধ্যম, এমনকি সর্বভারতীয় জামায়েতি ইসলাম হিন্দের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহমেদ দুর্গার বরখাস্ত আদেশের বিরোধিতা করে বিবৃতি প্রদান করেন। দুর্গার পক্ষ অবলম্বন করে সর্বভারতীয় আইএএস অফিসারদের সমিতি। তারা বরখাস্তের প্রতিবাদ করেন। কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্দেশ্য চিঠি লিখেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। চিঠিতে দুর্গার ওপর যেন কোনো অন্যায় না হয়, তা দেখার অনুরোধ করেন।

এর ফলে অখিলেশ যাদব পিছু হটতে বাধ্য হন। দুর্গা শক্তি নাগপালকে তার অফিসে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসে দেখা করলে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।

২০১৩ সালের সেই ঘটনা সেখানে নিষ্পত্তি হয়নি। একই কর্মস্থলে যোগদান করার পর তাকে আগের মতোই নানা বেআইনি চাপের মুখে রাখে অখিলেশ যাদবের প্রশাসন ও তার রাজনৈতিক দল।

২০১৪ সালের নির্বাচনে এনডিএকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে নরেন্দ্র মোদির সরকার। মোদি তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, ভারতীয় রীতি অনুসারে সরকারি কর্মচারীকে কোনো উচ্চ দায়িত্ব প্রদান করা হলে তাকে ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ বলা হয়।

এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (OSD) বিধানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ২০১২ সালে হাইকোর্টে এক রিট দায়ের করা হয়, যেখানে বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ওএসডি করে রাখা হয়। ওএসডি হওয়া অফিসারের কোনো কাজ বা দায়িত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু তিনি বেতন ভাতা সবই পান। রিটে উল্লেখ করা হয়, এটা সংবিধানের ২০(২) ধারা অনুযায়ী সংবিধানের লঙ্ঘন। সংবিধানের উক্ত ধারায় বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কেউ অর্জন করা নয়- এমন টাকা ভোগ করতে পারবেন না।

রিট শুনানির এক পর্যায়ে ১৩ মে ২০১৯, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে আদালতকে জানানো হয়, গত নয় বছরে ৩৬০৫ জন কর্মকর্তা ওএসডি হয়েছিলেন। জানুয়ারি ২০১৯, দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারের একজন সচিব গত ৮ বছর যাবত কোনো কারণ ছাড়াই ওএসডি হয়ে আছেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার আমাকে প্রতি মাসে বেতন দেয়; দেয় অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাদি, সার্বক্ষণিক গাড়ি, ড্রাইভার, জ্বালানি সব কিছু, অথচ আমার অফিস নেই, হাজিরা নেই, কাজ নেই, নেই কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব।’

উল্লেখিত রিট নিষ্পত্তির লক্ষ্যে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ৮ জানুয়ারি ২০২০ আদেশ দেন, কাউকে ১৫০ দিনের বেশি ওএসডি রাখা বেআইনি হবে। তাকে ১৫০ দিনের মধ্যে পূর্বতন কর্মস্থল (ওএসডি হওয়ার আগে যেখানে কর্মরত ছিলেন) পোস্টিং দিতে হবে।

দ্য নিউ এইজ পত্রিকা জানায়, গত ২০ জানুয়ারি ২০২০, জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নে জবাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সংসদকে জানান, এই সময়ে ২৯০ কর্মকর্তা ওএসডি হয়ে আছেন। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের অপচয় কি না ভেবে দেখতে হবে।

১৯৭৫ সালের পর চালু করা হয় ওএসডি’র বিধান। কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ওএসডি’র খড়গ তুলে না নিলে জনপ্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত গতি আসবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 17
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে