‘মার্শাল ল’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য জনসাধারণের দৃঢ় বিশ্বাসেরই প্রতিফলন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২০; সময়: ৪:৫৭ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
‘মার্শাল ল’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য জনসাধারণের দৃঢ় বিশ্বাসেরই প্রতিফলন

মাহফুজ আনাম : গত ৭ সেপ্টেম্বর আর্মড ফোর্সেস সিলেকশন বোর্ডের ভার্চুয়াল মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সামরিক অভিধান থেকে “মার্শাল ল” শব্দটি বাদ দেওয়া উচিত।’ প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্টবাদী এই বক্তব্য একইসঙ্গে বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক। বিস্ময়কর হলো এটির সময় এবং চিত্তাকর্ষক এর বিষয়বস্তু। প্রধানমন্ত্রী সামরিক বাহিনীকে তাদের অভিধান থেকে ‘মার্শাল ল’ বাদ দেওয়ার কথা বলে শুধু অভিধান থেকে একটি শব্দ বাদ দেওয়াই বোঝাননি। তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন, তার অর্থ কেবল এও নয় যে, এ ধরনের ঘটনার আর কখনও না ঘটুক। তিনি বুঝিয়েছেন, আমাদের সেনাবাহিনীর মন-মানসিকতা বা চিন্তা জগত থেকেও এটা বাদ দেওয়া উচিত।

কারণ হিসেবে তিনি যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে, অতীতের সামরিক শাসন আমাদের দেশ বা জনগণের কোনো কল্যাণ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, সারাবিশ্বের কোথাও কোনো মানুষের কল্যাণ করতে পারেনি সামরিক শাসন। এই সত্য জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে দেখা গেছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ থাইল্যান্ড ও মিশর এবং এই দুই দেশেও এটি ব্যর্থ ও অপ্রিয় প্রমাণিত হয়েছে।

সশস্ত্র বাহিনীর দিক থেকেও এসব অভ্যুত্থানগুলো বিপর্যয়কর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। যা সাধারণ জনগণের কাছে তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ, অহংকারী, নিন্দনীয় হিসেবে পরিচিত করেছে। ইমেজ সংকটে পড়েছে সামরিক বাহিনী। ফলে সাধারণ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস ও সন্দেহের প্রাচীর।

প্রতিটি সামরিক শাসনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো অস্বচ্ছ ও জবাদিহিতাহীন আজ্ঞাবহতায় পর্যবসিত হয়েছে। দেশের জনগণ যা প্রত্যক্ষ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই জনদৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। মূল্য দিয়ে দেশের জনগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, কিছু গুণাবলী-সম্পন্ন সামরিক স্বৈরশাসকের চেয়ে তুলনামূলক বিচারে যদি দুর্বলও হয়, তবুও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারই তারা প্রত্যাশা করেন।

পাকিস্তান আমাদের জন্য যে বহুসংখ্যক খারাপ দৃষ্টান্ত রেখে গেছে, এর মধ্যে সামরিক শাসনের উত্তরাধিকারই সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিকর। পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনা ধারণ না করলে বাংলাদেশি অফিসাররা কখনই অভ্যুত্থান ঘটাতে বা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারত না। যদিও পরিতাপের বিষয় তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা নেয়, আমার তখনকার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক স্মৃতি হলো অভ্যুত্থানের কয়েকদিনের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর মদদে পুলিশ আমার বাবা আবুল মনসুর আহমদকে গ্রেপ্তার করে। এরপর শুরু হয় বাবার সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় থাকার পালা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে তার সঙ্গে দেখা করা এবং অপেক্ষা করা যে কখন তাকে আদালতে নেওয়া হবে। আমরা সকাল থেকেই অপেক্ষা করতাম। সকাল নয়টা থেকে ১১টার মধ্যে যেকোনো সময়ে কারাবন্দিদের বের করা হতো এবং শুনানি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আদালত প্রাঙ্গণে রাখা হতো। এর মধ্য দিয়েই আমরা বাবার সঙ্গে সারাটা দিন কাটানোর সুযোগ পেতাম। যদিও সেসময় বাবা আমাদেরকে সময় দেওয়া ছাড়াও আইনজীবী ও তাকে দেখতে আদালত প্রাঙ্গণে আসা আওয়ামী লীগ নেতা ও অন্যান্যদেরও সময় দিতেন।

আমি এখনো বাবার মুখটি স্মরণ করি, সদা হাস্যোজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। বাবা যা করতেন বা তার যেটা করা উচিত, তা নিয়ে কখনই তিনি দ্বিধাগ্রস্ত থাকতেন না। হাস্যরসবোধ এক মুহূর্তের জন্যেও তিনি ছাড়েননি।

পশ্চিমা শক্তি, বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন ১০ বছর অব্যাহত ছিল। পরে ক্ষমতা নেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। যা শেষ হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে। সুতরাং আমাদের তরুণকাল, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো কেটেছে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগান ও প্রতিবাদ এবং পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে। শিক্ষার্থীরা সামরিক শাসকের পতনের দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার ছিল। ছাত্র আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়ে আমি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম কেন আমার বাবাকে জেলে পাঠানো হলো এবং কেন তিনি লড়াই করে যাচ্ছিলেন। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম যে সামরিক শাসন গণতন্ত্র, সাধারণভাবে পাকিস্তানে আইনের শাসন এবং শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতিকে (বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের) কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছিল।

তাই বেসামরিক জীবনে যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপের প্রতি লাখো তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মতো আমার হৃদয়ও ঘৃণায় ভরে গেছে। পরবর্তীতে অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের যে ভূমিকা ছিল, সেটা আমাকে তাদের প্রতি পুনরায় শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছে। একইসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও পূর্ব বাংলার বাঙালিদের স্বাধীনতায় তাদের সাহসী উদ্যোগে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি।

কিন্তু, যখন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশ আমাদের নেতা, জাতির পিতা, নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও আমাদের অনুপ্রেরণার ভিত্তিপ্রস্তরকে হত্যা করল, তার পরিবারের অনেক সদস্যকেও হত্যা করল, ছাড় দেয়নি ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও, তখন আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি আমাদের হৃদয় আবারও ঘৃণায় ভরে উঠল। এই কাজের বর্বরতা ছিল নজিরবিহীন। এর পরিণতি ছিল ধ্বংসাত্মক ও স্থায়ী একটি ভয়ংকর ক্ষত।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন, জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়ে ১৮টি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানেরও সামরিক অভ্যুত্থানেই মৃত্যু হলো এবং ক্ষমতা নেয় জেনারেল এরশাদ। জেনারেল এরশাদের সরকার আধা-সামরিক রূপ নিয়ে ১৯৯০ সালের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।

বিগত ৩০ বছরের (২০০৭-২০০৮ সাল ছাড়া) বেসামরিক শাসন ব্যবস্থায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবৃদ্ধি এসেছে, এতে আবারও সামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে রাজনৈতিক নিয়মে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই প্রমাণ হয়।

সামরিক অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলা যায়, পৃথিবীতে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তপ্ত হয়ে উঠল, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মদদে সামরিক অভ্যুত্থান বিশ্বব্যাপী ফ্যাশনে পরিণত হলো, বিশেষ করে সিআইএ যখন সর্বত্র এটিকে বামপন্থি ও কমিউনিস্টদের পতনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। একইসঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক স্বৈরশাসকদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সহায়তা দিয়ে পুরস্কৃত করে আসছিল।

এখানে ১৯৫৮ সালের পাকিস্তানের বিষয়টি সম্পর্কে বলা দরকার যে, এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন অভিযানের প্রথম উদাহরণ। যা পরবর্তীতে অন্যান্য দেশে কমিউনিজম নিয়ন্ত্রণের নামে সামরিক অভ্যুত্থানকে উৎসাহিত করেছিল। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সদ্য জন্ম নেওয়া দেশটিতে গণতন্ত্রের যেকোনো সম্ভাবনা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল সামরিক শাসন। একইসঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে বৈষম্য বৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। যে কারণে উপলব্ধি হয়েছিল যে, স্বাধীনতাই মুক্তির একমাত্র উপায়।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যদিও এই আলোচনাটি নতুন নয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা শুধু বাংলাদেশের জন্যেই প্রযোজ্য নয়, বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও যা তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে যেসব দেশে বারবার সামরিক শাসন এসেছে। সার্বজনীনভাবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের আবারও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়তা করে যে, একটি দেশের সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষার জন্যে, দেশ শাসনের জন্যে নয়। একথা বলার সুযোগ সবসময় অবারিত থাকা দরকার।

বর্তমানে আমাদের সামরিক বাহিনী এমন এক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে, যার অবস্থান বঙ্গবন্ধু হত্যা বা জিয়া ও এরশাদের দিনগুলোর চেয়ে অনেক দূরে।

আজ আমাদের সামরিক বাহিনী একটি পেশাদার বাহিনী। পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে তারা গণতন্ত্রের প্রতি বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা সুশৃঙ্খল ও দক্ষ। তাদের মধ্যকার দেশপ্রেম নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

তবে, সত্য হলো প্রশংসা করা ছাড়া সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে আমরা প্রকাশ্যে আর কিছুই বলতে পারি না। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, যেটি বলার জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি, সেটি শুধু তিনিই বলতে পারেন।

প্রাসঙ্গিকভাবেই এই প্রশ্নটি সামনে আনতে চাই, যদি কোনো পত্রিকা আজকে এই ধরনের মত প্রকাশ করত, তাহলে সেই পত্রিকা ও পত্রিকার সম্পাদকের পরিণতি কী হতো? আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে যা সরবরাহ করা হয়, তার বাইরে কোনো জাতীয় গণমাধ্যম সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে কার্যত কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না। এটা কি সামরিক বাহিনীর জন্য ভালো? তাদের কি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার বাইরে থাকা উচিত? এবং কেন? এই প্রশ্নগুলো নতুন নয় এবং শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক নয়। সামরিক শাসন অধ্যুষিত সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক।

গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত সব দেশেই সামরিক গোপন বিষয়গুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করে তারা সামরিক বাহিনীকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার উপায় খুঁজে পেয়েছে। এই দেশগুলো থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছুই রয়েছে।

আমার মতে, সর্বাধিক অনুসরণীয় উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়া। সামরিক বাহিনী কয়েক দশক ধরে দেশটি শাসন করেছিল এবং সেই সময়ে তাদের অবস্থান দ্বিতীয় শ্রেণির অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে ছিল। দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা অলৌকিকভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি গণতন্ত্রের উত্থান ও রাজনৈতিক শক্তি থেকে সামরিক শাসন অপসারণের সম্পর্ক রয়েছে। এবং এটি ঘটেছে এমন সময়ে যখন দেশটির উত্তরের প্রতিবেশী তার অস্তিত্বকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে চলেছে।

আজ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বে আদর্শ। করোনা মোকাবিলায় তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকেও অনেক এগিয়ে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমেই দক্ষিণ কোরিয়া তাদের গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করেছিল।

একটা সময় ছিল যখন এনডিসি ও স্টাফ কলেজে সেমিনারে সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকদের আলোচনার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হতো। আমিও অনেকবার সেখানে গিয়েছি। সেনাবাহিনীর মধ্যম ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু থাকত— ‘কীভাবে সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়’।

অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা উপস্থিত থাকতেন, তাদের মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতীয়মান ছিল। তাদের সঙ্গে আলোচনায় আমার মনে হয়েছিল, তারা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্যে সামরিক বাহিনীর সংবাদ সংগ্রহের দ্বার উন্মুক্ত রাখবেন। প্রতিবার আলোচনার পর ‘পরিবর্তন আসবে’ এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমি আমার কাজে ফিরে যেতাম। কিন্তু, বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তি ছাড়া সামরিক বাহিনীর কোনো সাধারণ বিষয়ের সংবাদ প্রকাশের অনুমোদন গণমাধ্যমের নেই।

এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। সেনাবাহিনীর আবাসিক এলাকা ডিওএইচএস’এ অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল দ্য ডেইলি স্টারে। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আমাদের নিয়ম অনুযায়ী আমরা মন্তব্য নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যখন যোগাযোগ করেছি, তখন তারা এই প্রতিবেদন করতে নিষেধ করেছিল। আমাদের সংবাদকর্মীকে তারা প্রশ্ন করেছিল, ‘এটা কীভাবে আপনাদের জন্য উদ্বেগজনক?’ সে সময় ফোনে আমাদের প্রতিবেদককে তিরস্কার করা হয়েছিল। প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘না’ করা সত্ত্বেও আমরা প্রতিবেদনটি কেন প্রকাশ করেছি? আমাদের প্রতিবেদককে বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে তিনি যেন কোনো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ না করেন। এই প্রতিক্রিয়াটি এসেছিল ডিওএইচএস’এ গাছ কাটা নিয়ে প্রতিবেদনের জন্য, যা তাদের ‘সংরক্ষিত এলাকা’র মধ্যেও পড়ে না।

এমন মন-মানসিকতা, চিন্তা ও বিবেচনাবোধের পরিবর্তন দরকার। সশস্ত্র বাহিনীর বৃহত্তর মঙ্গলের জন্যই পরিবর্তন দরকার।

এটি অনস্বীকার্য যে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের উত্থানের পর সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষত তাদের গোয়েন্দা শাখার ভূমিকা অত্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে নিজ দেশের জনগণের ওপর নজরদারিও তাদের কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে কাজের মধ্যে গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি এবং সেখানে কী প্রকাশ বা প্রচারিত হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করাও রয়েছে। অনেক দেশের সামরিক বাহিনী নিজেদের ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক তৈরি করছে, যেখানে সাংবাদিকদেরও বেতনভুক্ত কর্মী হিসেবে রাখছে। যা পরিশেষে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করছে। এটা বলা বোকামি হবে যে, যখন অনেক দেশেই এমনটি হচ্ছে, তখন আমাদের এখানে হচ্ছে না।

যদি আমাদেরকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিতে হয় এবং আমরা মনে করি সাড়া দেওয়া অবশ্যই উচিত, তাহলে অবশ্যই সামরিক হস্তক্ষেপের পেছনের সব কারণ ও যুক্তি অপসারণ করতে হবে।

আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদেরকে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে বিরোধীদল ও দ্বিমত পোষণকারীদের দমনে।

আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, যদি সত্যিই আমরা সন্ত্রাস নির্মূল করতে চাই ও চরমপন্থার কারণগুলো দূর করতে চাই, তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও জনসাধারণের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি ও সন্দেহের অবসান ঘটাতে হবে। এবং এটা করতে হলে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক উন্নয়নে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন ও প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে।

একটি উপাখ্যান দিয়ে শেষ করা যাক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডার বিষয়ে ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে কারণে আমাকে কলকাতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। দ্রুততার কারণে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা হলো উড়োজাহাজে। আমার ফ্লাইটটি গৌহাটি হয়ে ‘চিকেন নেক’র ওপর দিয়ে আসছিল। ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে আমাকে উড়োজাহাজ থেকে নামার অনুমতি দেওয়া হলেও টারম্যাকে থাকতে বলা হয়েছিল। পরে প্লেনে ওঠার সময় হঠাৎ দেখলাম একটি সামরিক যানে দুই জন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা (যা আমি পরে জেনেছিলাম) আসলেন, যারা আমাদের কয়েকজন ট্রানজিট যাত্রীর সঙ্গেই দ্রুত প্লেনে উঠলেন।

কেবিনের ভেতরে দেখলাম ওই দুই কর্মকর্তা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। যেহেতু আমি বসে ছিলাম, আমি দেখলাম তারা যাত্রীদের কাছে ফাঁকা আসনের বিষয়ে খোঁজ করছেন। কারণ, তখনও আসনের বিষয়টি কম্পিউটারাইজড হয়নি।

অথচ এই দৃশ্য আমার দেশে (যদিও তখন আমাদের দেশ পাকিস্তান ছিল) আমি কল্পনাও করতে পারি না, যেখানে একজন মেজর জেনারেল অন্য যাত্রীদের বসার জন্য অপেক্ষা করবেন এবং ফাঁকা আসনের বিষয়ে জানতে চাইবেন এবং এরপর বসবেন।

সাধারণত, তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকে এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তারা থাকবেন যারা তাদের পথ পরিষ্কার করে সঠিক আসনে নিয়ে বসাবেন এবং এরপর সাধারণ যাত্রীরা বসার অনুমতি পাবেন।

৪৯ বছর পরেও আমি স্পষ্টভাবে স্মরণ করি সেই দৃশ্য এবং এই ঘটনা থেকে পাওয়া বার্তা, যা বোঝায় একটি গণতন্ত্রে (যেখানে রয়েছে অধিকার, গৌরব ও পারস্পরিক মর্যাদা) বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ক।

পুনশ্চ: যদি এই লেখাটি নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যা আসে এবং ‘এটি লেখার পেছনে লেখকের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?’ এমন প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে আমি অবাক হব না। উদ্দেশ্য দেশপ্রেম ছাড়া আর কিছুই নয়।

মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক

সূত্র : দ্য ডেইল স্টার

  • 29
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে