অনাচারের স্বীকৃতি শুদ্ধাচার পুরস্কার!

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২০; সময়: ৪:০৭ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
অনাচারের স্বীকৃতি শুদ্ধাচার পুরস্কার!

রুমিন ফারহানা : ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের অর্পিত কাজ দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করার স্বীকৃতিস্বরূপ শুদ্ধাচার পুরস্কার পান তিনি। সেরা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার।

ঢাকা দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জ মিলে ১৩ লাখ গ্রাহককে সেবা দিতে ডিপিডিসির ৩৬টি আঞ্চলিক কার্যালয় আছে। একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনার এই বীভৎস সময়ে ডিপিডিসি তাদের এই কার্যালয়গুলোতে চিঠি দিয়ে বেশি বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। ডিপিডিসির আইটি শাখা থেকে সংস্থাটি ৩৬টি স্থানীয় কার্যালয়ে (এনওসি) চিঠি দিয়ে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিল বেশি করতে বলা হয়। এমনকি এই বাড়তি বিল ৩৬টি কার্যালয়ে কী পরিমাণ বেশি করতে হবে তাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের তিন মাসের বিলের সঙ্গে তুলনা করে এ বছরের তিন মাসে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ বিল বেশি করতে বলা হয়। অর্থাৎ, প্রকৃত যা বিল তা থেকে ৬১ শতাংশ বেশি! যেখানে বিশ্বের বহু মানবিক রাষ্ট্র এই ধরনের বিল নেওয়া তো দূরে থাকুক বরং নাগরিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, সেখানে ডিপিডিসি এই বেআইনি কাজ করে গ্রাহকের কাছ থেকে করোনার মতো চরম দুর্যোগকালে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আর তার প্রধান পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার।

শুধু ডিপিডিসি নয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার গ্রাহকরা করোনাকালে ভূতুড়ে বিলের খপ্পরে পড়েছিলেন। এর মধ্যে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের বিতরণকৃত ২১টি জেলার মধ্যে তিনটি জেলায় ১৬০ শতাংশের বেশি বাড়তি বিল নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
মানুষের তীব্র ক্ষোভ আর ব্যাপক সমালোচনার মুখে সে সময় বিদ্যুৎ বিভাগের ব্যাখ্যা ছিল, করোনার কারণে যেহেতু বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার রিডাররা বিল করতে পারেননি, তাই এই বিভ্রান্তি। কিন্তু পরে দেখা গেল, এই বাড়তি বিল মোটেও ভুল বা অনিচ্ছাকৃত নয়। বরং ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই জনগণের ওপর বাড়তি বিল চাপিয়ে দিয়েছে। সাদা বাংলায় বলতে গেলে ডিপিডিসি সাধারণ মানুষকে পরিকল্পিতভাবে ভোগান্তিতে ফেলে বাড়তি অর্থ আদায় করেছে। আর তার পুরস্কারস্বরূপ ডিপিডিসির এমডি পেয়েছেন শুদ্ধাচার পুরস্কার। বাড়তি বিলের উদ্দেশ্য ছিল বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। একই সঙ্গে প্রথাগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে দেখানো। উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই, শুধু পথটা যদি সৎ হতো!

শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ার একটি নীতিমালা আছে। ২০১৭ সালে প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার নীতিমালা অনুযায়ী জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের রূপকল্প ‘সুখী-সমৃদ্ধি সোনার বাংলা’ এবং অভিলক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। সেই নীতিমালায় ১৯টি সূচকের কথা বলা আছে, যার ভিত্তিতে এবং কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যক্তি নির্বাচন করা হয়। ১৯টি সূচকের ১৮টিতে ৫ নম্বর করে এবং ১৯ নম্বর সূচকে ১০ নম্বর ধরে যিনি নূ্যনতম মোট ৮০ নম্বর পাবেন, তিনিই এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারেন। ১৯টি সূচকের অন্যতম হলো, সততার নিদর্শন, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে আচরণ, প্রতিষ্ঠানের বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, সমন্বয় ও নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে আগ্রহ, অভিযোগ প্রতিকারে সহযোগিতা। এই প্রতিটি সূচকে ৫ নম্বর করে ধরা হয়েছে অর্থাৎ, এই ৮টি সূচকে মোট ৪০ নম্বর। করোনাকালে গ্রাহকের বিল নিয়ে ডিপিডিসি যে অনিয়ম করেছে, এই ৮টি সূচকে তাদের ০ পাওয়ার কথা। সেই হিসাবে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪০ নম্বর এমনিতেই বাদ যায়। তাহলে বাকি ১১টি সূচকে পূর্ণ নম্বর পেলেও তার মোট নম্বর দাঁড়ায় ৬০, যা নূ্যনতম ৮০ নম্বরের অনেক নিচে। অর্থাৎ, শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে যে নূ্যনতম মানদণ্ডের প্রয়োজন, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মান তার অনেক নিচে। কিন্তু তিনি শুধু যে বিবেচিত হয়েছেন তাই নয়, তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ওসি প্রদীপকে নিয়ে। মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যা প্রদীপকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এলেও তার নানা ‘কীর্তি’ আগে থেকেই সর্বজনবিদিত। এই ব্যক্তি ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন, যার সবক’টি ঘটনাতেই আসামি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

না, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতি সমর্থনের কথা কখনও অস্বীকার করেননি প্রদীপ। যে দেশে সংসদে দাঁড়িয়ে সাংসদরা বারবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কথা বলেছেন, সে দেশে প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ মডেল থানার সভায় প্রকাশ্যে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন।
সভ্য সমাজে ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য তিরস্কার বা শাস্তির বিধান থাকে। বলা হয়, যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সেই সমাজে গুণী ব্যক্তির জন্ম হয় না। গুণ যদি সরিয়েও রাখি, যে সমাজ অপরাধীকে কেবল যে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে তাই না, বরং তার নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে পুরস্কৃত করে, স্বীকৃতি দেয়, সেই সমাজে যে পচন ধরেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি সীমাহীন দুর্নীতি, অদক্ষতা, অযোগ্যতা প্রমাণিত হওয়ার পরও এই দেশে বিভিন্ন সংস্থার উঁচু পদে থাকা মানুষরা বছরের পর বছর একই পদে থেকে যান, শাস্তি ভোগ তো দূরে থাকুক বরং পদ আঁকড়ে থেকে পুরস্কৃত হন নানাভাবে।

বাংলাদেশে দুর্নীতি কিংবা আইনের অপব্যবহার নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু নতুন যে বিষয়টি গত কয়েক বছরে যুক্ত হয়েছে, তা হলো শিষ্টের দমন, দুষ্টের পালন। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নয়। এখন সব ক্ষমতার উৎস আর জনগণ নয়, বরং পুলিশ, প্রশাসন, আমলা। তাই জনগণকে এই তাচ্ছিল্য, উপেক্ষা। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা জনগণের সঙ্গে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে, তাদের ‘শুদ্ধাচার’ পুরস্কার দেওয়াই যায়।

রুমিন ফারহানা : সংসদ সদস্য ও কলাম লেখক

সূত্র : সমকাল

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে