প্রণব মুখোপাধ্যায়: রাজনীতি ও বিতর্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২০; সময়: ১:২৫ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
প্রণব মুখোপাধ্যায়: রাজনীতি ও বিতর্ক

গৌতম রায় : বর্ণময় ভারতীয় রাজনীতিক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু গোটা উপমহাদেশেই একটা শূন্যতা তৈরি করল। গত শতকের ছয়ের দশকে বিয়াল্লিশের বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন প্রণববাবু। ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির গতিধারাতে তিনি বহমান ছিলেন।

ভারতের রাজনৈতিক প্রবাহমানতায় প্রণব হলেন সেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রথা ভেঙে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরেও বিজেপির মূল মস্তিষ্ক আরএসএস এর সদর দপ্তর, মহারাষ্ট্রের নাখপুরের রেশমবাগের কেশব ভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন।

সেখানে তিনি আরএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার, যিনি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ তত্ত্বের অন্যতম উদ্ভাবক, তার মূর্তিতে মালা দিয়েছিলেন। অথচ চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী এবং মুসলিমবিদ্বেষী হেডগেওয়ারকে ঘিরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কখনো কোনও রকম উৎসাহ দেখায়নি। কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ করে, সঙ্ঘের সদর দপ্তরে বসে, সেই হেডগেওয়ারকে ভারতের মহান সন্তানের স্বীকৃতি প্রণববাবু দিয়েছিলেন। সঙ্ঘ কর্মীদের সামনে বক্তৃতাও করেছিলেন।

যে রাজনৈতিক মূল্যবোধে ছয়ের দশকে কংগ্রেস ছেড়ে বাংলা কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের বুকে তৈরি করেছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়, সেই মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত হয়েই, ওই দলে প্রণববাবু যোগ দিয়েছিলেন কিনা এটা একটা বিতর্কিত প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অকংগ্রেসী মন্ত্রিসভাকে দেখার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারা বলেন, অজয় মুখোপাধ্যায়ের আমলে কেবল মুসাবিদাকারী হিসেবে থেকে যাওয়াটা প্রণববাবু নাকি সেভাবে মেনে নিতে পারেননি।

বস্তুত সেই সময়ের মন্ত্রী, সুশীলধারা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বেশি কাছের লোক হওয়ার ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া করে মুখ্যমন্ত্রীকে ১৯৬৭ সালের ২ অক্টোবর পদত্যাগ করানোর প্রশ্নে বিশেষ সক্রিয় ছিলেন প্রণববাবু।

রাজনৈতিক জীবনের এ সূচনাকালেই প্রণববাবু কূটনীতি পারদর্শী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাময়িক ছেদ বাদ দিলে তার ছিল কংগ্রেসের সাথে সুসম্পর্ক। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসা বাংলা কংগ্রেস ক্ষমতা থাকা অবস্থাতেই প্রণবের কংগ্রেসের সাথে সুসম্পর্কের সূচনা।

সেদিক থেকে বিচার করে দেখলে বলতে হয়- প্রণবই সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি পশ্চিমবঙ্গের বুকে একটি দলে অবস্থান করে, বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে একটা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সরকার ফেলে দেওয়ার যে কর্মকাণ্ড তার সূচনা করেছিলেন। সরকারপক্ষে থেকে বিরোধিদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে সরকারের স্থায়িত্ব ঘিরে সংশয় তৈরির এ বুদ্ধিমত্তাই প্রণববাবুকে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই একটা অন্যধারার রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরেছিল।

এ সংযোগসূত্রেই তার কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রণবের বাবা ছিলেন বীরভূমের কংগ্রেস নেতা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, যিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

বিয়াল্লিশের আন্দোলনে অংশ নিয়ে কামদাবাবুর সাথে একসঙ্গে সিউরি জেলে ছিলেন কলিম শরাফি। তবে কামদাবাবু ভারতের স্বাধীনতার পর প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা সংযোগ রাখেননি। তাই বিধান রায় বা প্রফুল্লচন্দ্র সেনের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে আমরা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনও ঘটনাই দেখি না। এ সময়ে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার একটি কলেজে অধ্যাপনায় ব্যস্ত থেকেছেন।

দিল্লীর রাজনীতিতে প্রণববাবু সাতের দশক থেকেই ধীরে ধীরে একটা জায়গা করে নেন। তবে সাতের দশক থেকেই ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে তার সক্রিয়তা। সেই সূত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কিছু কর্মকাণ্ড, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর শেখ হাসিনার দিল্লী অবস্থানকালে, তাদের প্রতি সহমর্মী ভূমিকায় প্রণব একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিস্ফূট হন। কিন্তু সরাসরি জনতার ভোটে গোটা বিশ শতকে একটি বারও তিনি ভারতীয় সংসদে যেতে পারেন নি।

বৌদ্ধিক স্তরের রাজনীতি হিসেবে সর্বভারতীয় স্তরে ধীরে ধীরে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হলেও, মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে গোটা বিশ শতকে যেসব নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সবকয়টিতেই গোহারা হেরেছেন। সুদূর গুজরাট থেকে রাজ্যসভার ভোটে জিতে তাকে ইন্দিরা ক্যাবিনেটের মন্ত্রী থাকতে হয়েছিল।

প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় বাঙালি অর্থমন্ত্রী। তার আগে পাবনার ভূমিপুত্র শচীন চৌধুরী ছিলেন ভারতের প্রথম বাঙালি অর্থমন্ত্রী। ইন্দিরা ক্যাবিনেটে প্রথমে বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রণববাবু। জরুরি অবস্থার সময়ে এবং তারপরে, বিশেষ করে জরুরি অবস্থার কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানে গঠিত শাহ কমিশনে বিশেষ ভাবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছিলেন প্রণববাবু। তাই ১৯৮০ সালে ইন্দিরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসার অব্যবহিত পরে প্রণববাবু বাণিজ্যমন্ত্রী হলেও, অচিরেই ভারতের অর্থমন্ত্রী হন। কার্যত সেই সময়ে তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের দ্বিতীয় ব্যক্তি।

এ সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থিরা ক্ষমতায় এসে গেছেন। অশোক মিত্র পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী, জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে জরুরি অবস্থার সময়ে দেশের সংবিধানকে অমান্য করার যে সহবৎ ইন্দিরা লাগু করেছিলেন, পরিবর্তিত উপায়ে সেই পথে হাঁটতে শুরু করলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। জরুরি অবস্থার দরুণ পরাজয় থেকে ইন্দিরা রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রশ্নে এ সময়ে অত্যন্ত সতর্কিত। তার সেই সতর্ক পদচারণারই দৃষ্টান্ত হল, দেশের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ক্ষুণ্ণ করে রাজ্যের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সঙ্কোচিত করা।

সেই সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকার। সেই সরকারগুলির অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সঙ্কোচিত করে গোটা ভারতকে কেন্দ্রিয় সরকারের দয়ার দানের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে, ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সব থেকে নির্ভরযোগ্য সহযোগী হয়ে উঠলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। যেসব রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল না, সেইসব রাজ্যগুলিকে ভাতে মেরে ইন্দিরার নতুন পর্যায়ের শাসনকালকে একটা ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে প্রণববাবু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করলেন।

জ্যোতি বসু ব্যাতীত সেই সময়ের অকংগ্রেসী রাজনীতিকরা প্রথমদিকে প্রায় বুঝেই উঠতে পারেননি ইন্দিরা-প্রণবের এই কৌশল। জ্যোতি বাবু এই সময়ে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা এবং অর্থনীতির বিকেন্দ্রিকরণের দাবি নিয়ে জাতীয় স্তরে যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে দিয়েছিলেন, তার ভিত্তিভূমি নির্মাণে ড. অশোক মিত্রের ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা।

ওভারড্রাফটের প্রশ্নে এ সময়ে দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে অঙ্গরাজ্য, বিশেষ করে যেসব রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকার রয়েছে, সেইসব রাজ্যগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সরকার একদম মনিব-ভৃত্যের সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছিল।

রাজ্যগুলোর বরাদ্দের টাকা তাদের হক এর বিষয়, কেন্দ্রিয় সরকারের কোনও দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় নয় এটা মানুষের দরবারে তুলে ধরেন জ্যোতি বসু। কী কী প্রশ্নে নতুন করে ভারতের সংবিধানের উপর আঘাত আসছে, আর সেই আঘাতের প্রেক্ষিতে অঙ্গরাজ্যগুলির অর্থনৈতিক অবরোধ কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্বকে বিঘ্নিত করবে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমস্যায় ফেলবে, গণতন্ত্রকে বিপন্ন করবে, এই প্রশ্নে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কার্যত গোটা ভারত জুড়ে একটা রাজনৈতিক সচেতনতার নব-অভ্যুদয় ঘটতে শুরু করে।

ওদিকে কেন্দ্রিয় সরকার এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায় অপছন্দের শাসকদের অন্তর্গত রাজ্যগুলোর উপর অবরোধ তৈরি করে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতাকে উসকে দিচ্ছিল। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হচ্ছিল। যার কারণে প্রতিবেশি বাংলাদেশে সদ্য বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত উত্তরকালের গণতন্ত্রের সংকটও অনেক দীর্ঘায়িত হয়েছে।

ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক হহত্যাকাণ্ডের জেরে সহানুভূতির ভোটে শেষবারের মতো একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস ভারতে ক্ষমতায় এসেছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কংগ্রেস ভারতের লোকসভাতে এককভাবে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। অকংগ্রেসী রাজ্যগুলির উপর অর্থনৈতিক অবরোধ করে বিরোধী রাজনীতিকদের জরুরি অবস্থা উত্তরকালে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে সুযোগ প্রণববাবু করে দিয়েছিলেন, তার জেরেই আজ পর্যন্ত একক রিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেসের আর ভারতের শাসন ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয়নি।

বিরোধিদের কণ্ঠরোধের ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থার সময়কালের মত রাজনৈতিক পথে না গিয়ে প্রণববাবুর মাধ্যমে অর্থনেতিক পথে হেঁটেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এই পর্যায়ে ইন্দিরা নিজে অতীতের জরুরি অবস্থার সময়কালের মতো সেভাবে সমালোচিত হন নি। সমালোচনার রাশটা বেশিরভাগই গিয়েছিল প্রণববাবুর উপরে। এই পর্যায়টি কিন্তু কংগ্রেস বিরোধিতার লক্ষ্যে ভারতের অন্য সব বুর্জোয়া রাজনীতিকদলগুলোকে কাছাকাছি আসার একটা বড় রকমের সুযোগ করে দিয়েছিল। সেইসময়ের অর্থনৈতিক অবরোধের নিরিখে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি , আরএসএস এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নিয়ে খোদ বামপন্থিরাও কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারেনি। গোটা অকংগ্রেসী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জরুরি অবস্থা উত্তরকালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে কিছুটা গ্রহণযোগ্য করে তোলবার ক্ষেত্রে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সেই সময়কালের অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক আচার-আচরণ এবং নীতিগুলোর একটা বড় রকমের ভূমিকা আছে।

গৌতম রায় : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। দীর্ঘকাল অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশা জীবনকেও নিবেদিত করতে চান সম্প্রীতির স্বার্থে।

সূত্র : বিডিনিউজ

  • 19
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে