‘রাষ্ট্র কি দায় নেবে?’

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২০; সময়: ৪:৪৯ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
‘রাষ্ট্র কি দায় নেবে?’

আলী রীয়াজ : ‘এই ঘটনার দায় কে নেবে? রাষ্ট্র কি এর দায় নেবে?’ চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি আবেদনের শুনানি চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে এই প্রশ্ন দুটি করেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট। রাষ্ট্রের পক্ষে আবেদনটি করা হয়েছিল। যারা বছরের পর বছর ধরে গুম হয়ে নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের বিষয়ে এই প্রশ্ন দুটি করেছিলেন আদালত। যদিও আদালতে করা এই আবেদনটি ক্রমবর্ধমান গুমের বিষয়ে ছিল না; ছিল পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের বিধানের বিষয়ে। কিন্তু, এর মধ্য দিয়ে গুমের বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ক্ষোভের চিত্রটি ফুটে উঠেছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার বিষয়ে ১৬ বছর আগে হাইকোর্টের দেওয়া একটি নির্দেশের বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে সরকারের করা রিভিউ পিটিশনের শুনানিতে এই কথাগুলো আদালত বলেন। এই ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়। হাইকোর্ট তা সংশোধনের কথা বললেও সরকার তা করেনি। হাইকোর্টের সেই নির্দেশের বিষয়ে সরকারের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেই সুপ্রিম কোর্ট আরও উদ্বেগজনক বিষয় ‘গুম’ নিয়ে সরল-সোজা প্রশ্ন দুটি করেন। সে সময় আদালতে চলমান শুনানির বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় আদালতের এই প্রশ্নের জবাব দেননি অ্যাটর্নি জেনারেল; অথবা তিনি উত্তর দেননি কেননা মনে হয়েছে প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকায়িত আছে।

বিগত এক দশকে গুম হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশে দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে চিত্র সামনে আসছে, বাস্তবে ঘটছে এর চেয়েও বেশি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৫৫৩ জন। আর বিগত ছয় মাসে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন ১৪ জন।

এই ঘটনার কাহিনিগুলো পরিচিত ও অনেকটা একই রকমের। পরিবারের সদস্য বা বন্ধুরা অভিযোগ করে থাকেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর (র‌্যাব বা পুলিশ) সাদা পোশাকধারী সদস্যরা বাসা বা রাস্তা থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে থাকেন। তবে, ওই ব্যক্তিকে নিজেদের হেফাজতে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যখন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজে পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় থানা বা র‌্যাব কার্যালয়ে যায়, তখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তিনি (যিনি নিখোঁজ হন) এখানে নেই’।

এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিশেষ করে যখন অভিযোগ থাকে স্বয়ং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে যে, পরিবারের সদস্যরা লিখিত অভিযোগ দিতে পুলিশ, র‌্যাব এবং সামরিক গোয়েন্দা ও মানবাধিকার কমিশনসহ সরকারি সংস্থার কাছেও গেছেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ‘নিখোঁজ ব্যক্তিটি কোথায়?’— এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই মেলে না।

কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা ‘নিখোঁজ’ হন, তারা রহস্যজনকভাবে ফিরে আসেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত অপহরণের শিকার হওয়া ৩১০ জনের মধ্যে ৩৩ জন ফিরে এসেছেন। কিন্তু, অনেকেই আসেননি। তাদের পরিবারের মানুষগুলো আশায় থাকেন একদিন, কোনো একদিন, তাদের প্রিয়জনও নিরাপদে ঘরে ফিরবে বলে। তারা প্রার্থনা করতে থাকেন এবং যখন সুযোগ আসে, তখন প্রিয়জনকে ফিরে পেতে কর্তৃপক্ষের কাছে এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আকুল আবেদন জানান।

তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা ও সরকারই ভরসা, যেখানে তারা কিছু চাইতে পারে এবং তারা তাই করে থাকেন। প্রায়শই ঊর্ধ্বতন পক্ষ থেকে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্তান, বাবা-মা বা স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা হয় এবং তাদের প্রিয়জনদের খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

কিন্তু, খুব কমই তারা তাদের প্রার্থনার জবাব পান। আর এর চেয়েও কম ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘নিখোঁজদের’ মরদেহ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ: ২০১৯ সালে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক ৩৪ জনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে বলা হয়। এদের মধ্যে আট জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং ১৭ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল কিংবা আদালতে নেওয়া হয়েছিল।

এসব ক্ষেত্রে তাদেরকে আদালতে হাজির করলে পরিবারের জন্য সেটা অনেকটাই স্বস্তির হয়। কারণ, জীবিত অবস্থায় প্রিয়জনের খোঁজ তো পাওয়া যায়। কিন্তু, ভুক্তভোগীরা দিনের পর দিন বা সপ্তাহর পর সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর কেমন করে তাদের খোঁজ মেলে, এই ব্যাখ্যা আর কখনই পাওয়া যায় না।

শুধু এই ঘটনাগুলোতেই নয়, গুমের বিষয়টিই সরকার সব সময়ই অব্যাহতভাবে অস্বীকার করছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতেও একইভাবে আইনমন্ত্রীসহ বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা গুমের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। আনিসুল হক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রায়শই গুমের ঘটনা হয় বলে যা বলা হয়ে থাকে, সেটির সঙ্গে আমরা একমত নই।’ হায়! যারা এখনো প্রিয়জনের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন এবং নিজেদের দরজার প্রত্যেকটি টোকাকে যারা আশা করেন তাদের স্বজনদের ফিরে আসা, মনে করেন ‘প্রিয়জন হয়তো ফিরেছেন’; তাদের কাছে যদি আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্য সত্যি হতো।

যদিও সরকার অব্যাহতভাবে গুমের বিষয়টি অস্বীকার করছে, তবে, যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এ ধরনের ঘটনা নিয়ে তদন্ত করেছে, তারা এগুলোর বিষয়ে সরকারের বিপরীত উপসংহারেই উপনীত হয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইডিএইচ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, গুমের এই ঘটনাগুলো বিক্ষিপ্ত বা স্বেচ্ছায় ঘটানো ঘটনা নয়। ‘এগুলো যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের সমন্বিত কৌশল কার্যকরেরই অংশ।’

এই ঘটনাগুলোকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ও ‘রাষ্ট্রীয় নীতিমালার পরিণাম’ হিসেবে বর্ণনা করে এফআইডিএইচ বলেছে, ‘যেহেতু বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে টার্গেট করা হয়, এই কাজগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ।’

‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’র এই অভিযোগটি ‘গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদ’ নামে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত চুক্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সনদের দুই নম্বর ধারা অনুযায়ী গুমের সংজ্ঞা— ‘রাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধি কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতায়িত, সমর্থিত বা রাষ্ট্রের মৌন সম্মতিতে কাউকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনোভাবে তার স্বাধীনতাবঞ্চিত করা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিকে স্বাধীনতাবঞ্চিত করার বিষয়টি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানানো, তার অবস্থান গোপন রাখা, যাতে তিনি আইনের সুরক্ষার বাইরে থাকেন, তা গুম হিসেবে বিবেচিত হবে।’

সনদের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা আছে— ‘প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, গুমের ব্যাপক বা নিয়মতান্ত্রিক চর্চা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং এর পরিণতি সেই সব আইন অনুযায়ী হওয়া উচিত।’

সুপ্রিম কোর্টের করা প্রশ্নের উত্তর আদালত কিংবা আদালতের বাইরেও দেননি অ্যাটর্নি জেনারেল। কিন্তু, আইনমন্ত্রীর অস্বীকার ওই দুই প্রশ্নেরই উত্তর।

যদি সরকার আত্মবিশ্বাসী হয় যে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে না, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে দেখাতে হবে যে সরকার তার দায়িত্ব পালন করেছে। সনদের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রের প্রতিটি পক্ষ অবশ্যই নিশ্চিত করবে যে, যেকোনো ব্যক্তির গুমের বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার অধিকার আছে এবং ওই কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ও নিরপেক্ষভাবে সেই অভিযোগ যাচাই করবে। একইসঙ্গে প্রয়োজনে অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করবে।’

যদিও বাংলাদেশ ‘গুম হওয়া থেকে সব ব্যক্তির সুরক্ষার আন্তর্জাতিক সনদ’ এ স্বাক্ষরকারী দেশ না, তবে, স্বাক্ষর না করলেও এগুলো মানতে তো বাংলাদেশের জন্য কোনো বাধা নেই।

সরকারের পক্ষ থেকে গুমের বিষয়টি অব্যাহতভাবে অস্বীকার করা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তবে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা আশ্চর্যজনক নয়। কারণ, সরকার এমন এক শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা কোনো ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে।

বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।

সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহির যে প্রক্রিয়া, তা যখন কার্যত অবসিত হয়েছে, তখন আরও বেশি দরকার হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জবাবদিহির চেষ্টা করা। কিন্তু, গুমের বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) কথা বলতে পারার ব্যর্থতার মাধ্যমেই জবাবদিহি না থাকায় তৈরি হওয়া সংকটের গভীরতা বোঝা যায়।

গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলার সময়ে এটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে, গুমের বিষয়টি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত; আর এটা খুব স্পষ্টভাবে বলা যে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।

আলী রীয়াজ, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার

 

  • 20
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে