জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মতানৈক্য ও উন্নয়ন ভাবনা

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২০; সময়: ২:৫৭ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মতানৈক্য ও উন্নয়ন ভাবনা

সাজ্জাদুল হাসান : বহুল প্রচলিত একটি কথা, যখন দুইজন ইংরেজ একত্রিত হন – তারা গঠন করেন একটি ক্লাব, দুইজন স্কটিশ যদি এক হন – তৈরি হয় একটি ব্যাংক, দুইজন জাপানি একত্রিত হলে জন্ম নেয় একটি গোপন সংগঠনের আর দুইজন বাঙালি একসাথে হলে সেখানে সৃষ্টি হয় তিনটি দলের! কথাটার মানে কী দাঁড়ালো তাহলে? কোনো বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো বাঙালির জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য বা বিরল একটা ব্যাপার। এখানে নানা মুনির নানা মত! যেকোনো বিষয়ে তৈরি হয়ে যায় পক্ষ ও বিপক্ষ। এমন অনেক বিষয়ে মতানৈক্য হয় যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় খুব সহজেই ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব। অনেক সময় আমরা কেবল বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করি। কথায় বলে না, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।

অনেকেই হয়ত বলবেন – ভিন্নমত, মতপার্থক্য এগুলো একটি মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। আর এর মধ্যদিয়ে বিকাশ ঘটে সমাজের, সৃষ্টি হয় নতুন-নতুন চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনের। তবে এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার যেখানে বিরাজ করে পরমতসহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সেটা গ্রহণের উদারনৈতিক মানসিকতা। যে সমাজে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হয় কিংবা যেখানে সবকিছুই ক্ষুদ্র দলীয় বা গোষ্ঠী স্বার্থে বিবেচিত হয় সেখানে মতানৈক্য, মতবিরোধ বরং স্বাভাবিক ঘটনা।

এ প্রসঙ্গে, সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কত? এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা এবং কথার লড়াই। সরকারের উচ্চপদস্থ মন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদগণ শামিল হয়েছেন এই বাহাসে। ব্যাপারটা আসলে কী?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। মহামারীর কারণে সৃষ্ট সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিঃসন্দেহে এই প্রবৃদ্ধির হার সন্তোষজনক। পরিকল্পনা মন্ত্রী এই অর্জনে তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছেন, ‘গত অর্থবছরের এক তৃতীয়াংশ সময় আমরা কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ছিলাম। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলতে হয়েছে আমাদের। মার্চ থেকে জুন এই চার মাস প্রায় সব কিছুই বন্ধ ছিল। তারপরও ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো বলে আমি মনে করি।’ যদিও অনেকেই প্রবৃদ্ধির এই উচ্চ হার অর্জন নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন। যার মধ্যে অন্যতম – সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ)। বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ সিপিডি তাদের বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন এবং মতামত তুলে ধরছেন। দেশের বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। স্বাভাবিক কারণে, তাদের মতামত গুরুত্বের সাথেই বিবেচিত হয় দেশের সচেতন মহলে। এ কথা বলা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, সিপিডি এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম থিঙ্কট্যাঙ্ক।

সিপিডি’র মতে, বিবিএস জিডিপির প্রবৃদ্ধির যে হিসাব প্রাক্কলন করেছে তা অতিরঞ্জিত। কেননা, তাদের এই হিসাবে মহামারীর কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাত আমলে নেয়া হয়নি। তারা (সিপিডি) তাদের বক্তব্যের সপক্ষে বেশকিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন। প্রথমত, গত অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে একমাত্র প্রবাসী আয় ছাড়া সব সূচকই ছিল নেতিবাচক। দ্বিতীয়ত, চতুর্থ প্রান্তিকে মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল মূলত স্থবির। সুতরাং এই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির প্রশ্নই উঠে না। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিপিডি বলেছে, বিগত অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। তারা এ-ও বলছেন যে, ‘এটা (জিডিপি) একটা রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। সরকার রাজনৈতিক সাফল্য দেখাতে প্রবৃদ্ধি ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছে।’

সিপিডির এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী মহোদয়। তিনি বলেন, “জিডিপি হিসাব যিনি বের করেন বা তৈরি করেন, তাকে একটি ভিত্তির উপর নির্ভর করতে হয়, হয় অনুমান আর না হলে তথ্য-উপাত্ত। আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো যে ভিত্তির উপর নির্ভরশীল, সেটি হলো তথ্য-উপাত্ত। সিপিডি যদি কোনো আন্দাজভিত্তিক জিডিপি নিয়ে কথা বলে, তাহলে কতটা গ্রহণযোগ্য তা আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারেন। তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছরে তাদেরকে আমরা দেখেছি একটি জায়গায় তারা আমাদের এসব (তথ্য) কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা বাজেট দিলেই তাদের অনুষ্ঠান করার সময় এসে যায়। সারা বছর কোনো অনুষ্ঠান করে না, কাঁচামাল এখান থেকে নিয়ে বিদেশে এক্সপোর্ট করে। এগুলো তাদের ব্যবসা, সহজ ব্যবসা।“ কী সাংঘাতিক কথা! এ বিষয়ে দেশের আরও কয়েকজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের বক্তব্য পর্যালোচনা করা যাক।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলামের মতে, প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে সন্দেহ তা অযৌক্তিক নয়। তিনি বলেন, বেশ অনেকদিন ধরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে কারণে বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) হিসাবের সঙ্গে প্রতিবছরই আমাদের সরকারি হিসাবের পার্থক্য দেখা যায়। পাশাপাশি তিনি মনে করেন, আমাদের অর্থনীতি মোটের উপর খারাপ করছে না। এর সপক্ষে তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে অর্থনীতি ভাল অবস্থায় ছিল। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে জিডিপি হিসাব করা হয় সেখানে অনেক কারসাজির সুযোগ থাকে। আর জিডিপির যেহেতু এখন রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে এর থেকে বের হয়ে আসা সহজ হবে না।

বিআইডিএসে’র মহাপরিচালক জনাব কে এস মুরশিদ মনে করেন, গত অর্থবছরে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর সপক্ষে তার যুক্তি, আমাদের অর্থনীতিতে একটা ঘাতসহনশীলতা আছে আর সে কারণে করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে অন্যান্য অনেক দেশের মতো এত প্রবল হয়নি। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, বিবিএসের প্রাক্কলনে কিছুটা বাড়িয়ে বলার প্রবণতা থাকতে পারে। তিনি যথার্থই বলেছেন, আমাদের বরং নজর দেয়া উচিত মানুষের জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি কতটুকু বাড়ল তার প্রতি। জিডিপি দিয়ে এগুলো নির্ণয় করা যায় না। আয় বৈষম্য, দারিদ্র্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব খাতের ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

ইদানীংকালে অনেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ একটি দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নির্ধারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারকে সূচক হিসাবে মানতে নারাজ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় মনে করেন, একটি দেশের টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি হলো প্রান্তিক জনগণের উন্নয়ন। তিনি এই কৌশলকে ‘গোয়িং স্মল’ নাম দিয়েছেন। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে আগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। তিনি মনে করেন, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত, তারা যদি সন্তোষজনক মজুরি পায়, তাহলে উৎপাদনে গতিশীলতা আসবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত হবে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে কীভাবে সমতার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এখন অনেক বেশি।

যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও লেখক বেঞ্জামিন ডিসরেইলি মিথ্যাকে ভাগ করেছেন তিনভাগে, মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা, ও পরিসংখ্যান। সংখ্যার অন্তর্নিহিত ও অমিত ক্ষমতা বোঝাতে রূপক অর্থে কথাটি বলা। পরিসংখ্যান কখনো কখনো বিভ্রান্তিকরও বটে। আমরা আশাবাদী আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির মতো অহেতুক সংখ্যার বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে অনতিবিলম্বে জনগণের প্রকৃত উন্নয়নের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রণয়ন করবেন। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। লাখো শহীদের স্বপ্ন – সোনার বাংলা বিনির্মাণে আমরা সকলে হই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

  • 12
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে