মেজর সিনহা হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রের ওপর আরেকটি আঘাত

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২০; সময়: ৯:৩৫ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
মেজর সিনহা হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রের ওপর আরেকটি আঘাত

শাখাওয়াত লিটন : ৩১ জুলাই। পুলিশের হাতে নিহত হলেন সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। আর আমরা শুনলাম সেই পুরনো গল্প।

এই গল্প চলছেই। ৩১ জুলাই রাত। এক চেকপোস্টে তার গাড়ি থামাল টহল পুলিশ। তারা যখন গাড়িটি তল্লাশি করছিল, বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না মেজর সিনহা, পুলিশের ওপর গুলি চালাতে উদ্যত হলেন। ‘আত্মরক্ষার্থে’ পুলিশ বাধ্য হলো গুলি করতে। মারা গেলেন ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

কিন্তু এই গল্প এখানেই শেষ নয়। পুলিশ দাবি করল, দুই বোতল মদ ও গাঁজা পাওয়া গেছে সিনহার কাছে।

এ ধরনের গল্প বহুবার বলা হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে, প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর, ওইসমস্ত বেআইনি কর্মে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরা সবসময় এমন গল্পই শুনিয়ে এসেছেন আমাদের।

টেকনাফ পুলিশের চোখে সিনহা ছিলেন পুলিশের ওপর গুলি চালাতে উদ্যত হওয়া এক ‘দুর্বৃত্ত’ ও ‘বদমেজাজি’ লোক। তার কাছ থেকে যেহেতু মদ ও গাঁজা ‘উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে’ পুলিশ, তার মানে তিনি ছিলেন ‘খারাপ মানুষ’ও।

মেজর সিনহার ভাবমূর্তিকে এভাবে কলঙ্কিত করার যে প্রচেষ্টা পুলিশের, সেটি ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিহিত করা হয়েছে একজন তুখোড় মেধাবী, পেশাদার ও সৎ কর্মকর্তা হিসেবে। তার পেশাগত সততা তাকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) একজন সদস্য করে তুলেছিল- যে স্কোয়াড বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে।

তাদের সাজানো গল্প মানুষ বিশ্বাস করে নাকি বানোয়াট বলে খারিজ করে দেয়- তা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। মানুষের হইচইকে খুব একটা পাত্তা দেয় না তারা।

তাদের এই উদাসীন মনোভাবের পেছনে একটা শক্তিশালী কারণ রয়েছে। ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চার হাজারেরও বেশি মানুষ। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য এবং আরও বেশ কিছু কারণকে এইসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য হিসেবে প্রতিবেদনে জানিয়েছে গণমাধ্যম।

কিন্তু এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রে। এ কারণে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর এমনতর বেআইনি কর্মে যুক্ত সদস্যরা এই বাস্তবতা সম্পর্কে বেশ ভালো জানেন যে, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। বরং তারা ব্যাপক মাত্রায় ছাড় পেয়ে যাওয়া উপভোগ করেন। হয়তো এ কারণেই তাদের বিচারবুদ্ধিও ভোঁতা হয়ে গেছে।

প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এর শিকার মানুষটির পরিবারের জন্য একেকটি অপূরণীয় ক্ষতি।

এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষতিও বিরাট। প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা দেশের সংবিধান, আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

ভূখণ্ডের সর্বোচ্চ বিধান হিসেবে সংবিধান কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যা সমর্থন করে না।

সংবিধান নিশ্চয়তা দেয়- জীবন ও আইনি সুরক্ষা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এটি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানায়, আইনের অধীনে কারও জীবন কিংবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হতে পারবে না।

এটি স্পষ্টভাবে আরও জানিয়ে দেয়, গণপ্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র হবে এমন ব্যবস্থা, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং ব্যক্তি মানুষের মূল্যের নিশ্চয়তা থাকতে হবেই।

আইনের সামনে জীবনের অধিকার, আইনের সুরক্ষা, কিংবা সমতার মৌলিক অধিকার যদি কারও লঙ্ঘিত হয়, তাহলে অধিকারের দাবিতে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারবেন। সংবিধান বিরোধ নিষ্পত্তি ও দোষির শাস্তি বিধানের ক্ষমতা বিচার বিভাগকে দিয়েছে।

সংবিধানের কাছ থেকে যেসব অধিকারের নিশ্চয়তা মেজর সিনহা পেয়েছিলেন, সবগুলো থেকেই বঞ্চিত করা হয়েছে তাকে। টেকনাফ পুলিশ স্টেশনের একদল পুলিশ তার বেঁচে থাকার অধিকারসহ সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তিনি এখন বাংলাদেশে বহুকাল ধরে টিকে থাকা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সেই হাজারও শিকারের একজন।

যখন কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন সংবিধান পরিণত হয় স্রেফ একটি পুস্তকে, হারিয়ে ফেলে নিজের আধিপত্য। দেশের বিচারিক ক্ষমতার চর্চাকারী বিচার বিভাগ হয়ে ওঠে অপ্রয়োজনীয়।

আইন প্রণেতাদের বোর্ড হিসেবে সংসদের আধিপত্যও খর্ব হয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী বিশ্বাসযোগ্যতা ও মানুষের আস্থা হারায়।

এক কথায় বললে, প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডই সংসদ, সরকার ও সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর রাষ্ট্রীয় গঠনের স্তম্ভগুলোর ওপর একেকটি আঘাত।

একটা উপমা টানা যাক। ধরা যাক, রাষ্ট্র একটি মানবদেহ। শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ ও অংশ যদি এতটাই আহত ও দুর্বল হয়ে পড়ে- চিকিৎসা দিয়ে যে ক্ষতি সারানো অসম্ভব, তখন শরীরটি আচমকা অকার্যকর হয়ে যায়।

রাষ্ট্রের বেলায়ও একই কাণ্ড ঘটতে পারে। যদি এটির স্তম্ভগুলো একের পর এক আঘাতপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মেরামতের উর্ধ্বে চলে যায়, তাহলে সেটি আর ঠিকঠাক কাজ করবে না।

তার মানে, এই বিচারবহির্ভূত হত্যার সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের দুশমন। জনগণ ও রাষ্ট্রের জন্য এই সংস্কৃতি কোনো সুফল বয়ে আনতে পারে না।

উদাহরণ হিসেবে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে সামনে আনা যাক। ২০১৮ সালের এপ্রিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী দেশজুড়ে কঠোর অভিযান পরিচালনা শুরু করার পর এ পর্যন্ত চার শতাধিক মাদক কারবারি খুন হয়েছেন।

কিন্তু মরণনেশা ইয়াবা এখনো রয়ে গেছে অপ্রতিরোধ্য। এ ঘটনা সাক্ষ্য দেয়, খুন করে ফেলা কোনো আইন-শৃঙ্খলা সমস্যার সমাধান নয়। বরং সমাধান নিহিত রয়েছে যথাযোগ্য আইনি প্রয়োগের ভেতর।

প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সরকারি তদন্ত এবং তা সংঘটনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মীরা তুলছেন।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীদের শাস্তির আওতায় আনা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার সংস্কৃতি থামানো গেলে এসব ঘটনায় বিক্ষত হওয়া রাষ্ট্রের স্তম্ভগুলোকে সারিয়ে তোলা সম্ভব বলে তারা মনে করেন। আর তাদের সেই দাবি সমর্থনযোগ্য।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 38
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে