আফ্রিকার যে দেশের ‘সরকারি ভাষা’ বাংলা

প্রকাশিত: ২২-০২-২০২১, সময়: ১৫:৫৬ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ‘নানান দেশের নানা ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা?’ রামনিধি গুপ্তের এই কবিতাংশ কেবল আমাদের নয়, বিশ্বের প্রতিটি মাতৃভাষাভাষী মানুষের কাছেই ধ্রুব সত্য। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ। দেশের জন্য যুদ্ধের নজির রয়েছে বিশ্বে অনেক অনেক, তবে শুধুমাত্র একটি ভাষার জন্য এই ঘটনা বিরল। বাঙালি জাতি একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন রাজপথে।

তাই তো মোদের গরব, মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষা নিয়ে আদের গৌরবের শেষ নেই। বাংলায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে অনেক রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন। বাংলা ভাষা পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যবহার করা হয়। একটি দেশ রয়েছে যাদের সরকারি ভাষাও বাংলা।

ভাবতে পারেন ভারতের কথা। না, এটি পশ্চিম আফ্রিকার দরিদ্র এক দেশ সিয়েরা লিওন। ১৯৫৩ সাল থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের দেশে শহীদদের স্মরণে পালন করলেও ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ভাষা শহীদদের সম্মানে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে, আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র রয়েছে, যা বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে নিজেদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে।

সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী একটি বহুভাষী দেশ। যা বিশ্বের বৃহত্তম বক্সাইট এবং টাইটানিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত দেশটিতে সোনা এবং হীরাও উৎপাদন করা হয়। ৭১,৭৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সিয়েরা লিওনে ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার প্রায় ৭.৬৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৭৬ লাখ মানুষের বসবাস (২০১৮)। ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্ত্বা থাকায় বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ দেখা যায় এখানে।

বহুভাষী দেশটিতে প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহৃত হলেও আরো ২৩টি ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ক্রিও স্থানীয় ভাষাগুলোর একটি সংকর রূপ, যা ভাবের আদান-প্রদানে অধিক ব্যবহৃত। সংকর ভাষা ক্রিওর কারণে কিছু কিছু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা গুরুত্ব কম পাচ্ছে বা বিলুপ্তির পথে। শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষই ক্রিও ভাষায় কথা বলতে পারে। অবশ্য শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারিভাবে ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করা হয়।

সময়টা ২০০২, এশিয়ার ছোট্ট বাংলাদেশ নামের একটি বদ্বীপে উদযাপিত হচ্ছে মহান ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী। আর এ বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের আফ্রিকান দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিওনের ভিন্নতা থাকলেও জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সুবাদে দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতি হলে ২০০২ সালে সিয়েরা লিওনে সরকারিভাবে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে এর আগে থেকেই দেশটির যেসব স্থানে বাংলাদেশ সেনাদলের অবস্থান ছিল, সেসব স্থানে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি নাচ-গান দেখা যায়।

১৯৬৪ সালে অসুস্থতার কারণে এই দেশের প্রধান্মন্ত্রী স্যার মিল্টন মারা যান। এরপর দেশটিতে দুর্নীতি ও অপশাসনের দরুন অরাজকতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অভ্যন্তরীণ কলহ দিন দিন বাড়তেই থাকে। পরিণতিতে স্বাধীনতার ত্রিশ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সিয়েরা লিওনে। এটি আফ্রিকার সবচেয়ে রক্তাক্ত ও ভয়াবহ গৃহযুদ্ধগুলোর একটি, যা ২০০২ সাল পর্যন্ত চলে। ১৯৯১ সালের ওই গৃহযুদ্ধে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ মারা যায়, বিশ লাখ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরনার্থী হিসাবে বাস্তুহারা হয়। ধ্বংস হয় দেশের অধিকাংশ অবকাঠামো।

সিয়েরা লিওন নিজেদের গৃহযুদ্ধ থামাতে অক্ষম হলে, এমনকি পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো একত্রিত হয়েও কোনো মীমাংসা করে দিতে না পারায় ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশ জাতিসংঘের এই শান্তি মিশনে যোগদান করেন। জাতিসংঘের প্রেরিত প্রথম দলে ৭৭৫ জন বাংলাদেশি সেনা ছিলেন। যুদ্ধের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলে একপর্যায়ে ৫,৩০০ জন সেনা একসঙ্গে কর্মরত ছিলেন সিয়েরা লিওনে। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বমোট ১২ হাজার সেনা শান্তি কমিশনের সদস্য হয়ে দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেন। যুদ্ধপরবর্তী দেশের পুনর্নির্মাণে সহায়তার তাগিদে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি সেনারা সিয়েরা লিওনে ছিলেন, যদিও যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ২০০২ সালে।

শুধু যুদ্ধ থামাতেই নয়, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি পুর্নগঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের সঙ্গে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে মিশুকে বাঙালি সেনারা। এজন্যই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে সিয়েরা লিওনের। রাজনৈতিক দুর্বল অবস্থা সামলাতে গিয়ে বাংলাদেশি সেনারা বন্দুক আর গুলির ব্যবহার করে থাকলেও স্থানীয় লোকজনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও পরিচিত হতে শুরু করে তারা। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে স্থানীয় লোকজন ও বাংলাদেশি সেনারা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করত। তবে, বন্ধুসুলভ বিদেশি সেনাদের মাতৃভাষা সম্পর্কে স্বভাবতই কৌতূহল জাগে স্থানীয়দের মধ্যে।

স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ভাষার আদান-প্রদান ঘটে। বাংলাদেশ সেনাদলের দরুন সেখানকার আঞ্চলিক মানুষজন বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করে এবং এর পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও প্রসার ঘটে সেসব অঞ্চলে, যেখানে তারা কর্মরত ছিলেন। তারা যতদিন সেখানে কর্মরত ছিলেন, প্রায়ই দেখা যেত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঙালি ধাঁচের নাচ-গান করত আঞ্চলিক লোকজন। বিশেষ করে তারা যেখানে বাস করতেন, ঐসব এলাকায় এ ধরনের পরিবর্তন বেশি পরিলক্ষিত হতো। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারের ফলে আঞ্চলিক লোকজন এবং বাংলাদেশ সেনাদের মধ্যকার সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কমতে শুরু করে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলে এবং ভাষাগত পরিচিতির ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বা সাধারণ জনগণকে বোঝানোর ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সেনাদের তুলনায় এগিয়ে ছিল আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ৩১টি দেশের সেনাদল কর্মরত ছিল। তবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি মন জয় করার চেষ্টায় সবসময়ই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ সেনাদল। শান্তি কমিশনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০০২ সালের ১৮ জানুয়ারি, অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর ৯ মাস পর সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দেশ পুনর্গঠনে অবদানের পাশাপাশি বন্ধুসুলভ আচরণ ও সম্প্রীতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভোলেনি সিয়েরা লিওন। সে বছরের ১২ ডিসেম্বর সিয়েরা লিওনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বাংলাদেশ সেনাদলের নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধন করার সময় তিনি এই ঘোষণা দেন।

এ সময় জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ওলুয়েমি আদেনজি, জাতিসংঘ বাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড্যানিয়েল ইসলায়েল ওপান্ডেও উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পরে প্রেসিডেন্ট কাব্বা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিনদিনের জন্য বাংলাদেশ সফরের জন্যও আসেন। কোনো বিদেশি ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা মর্যাদা দেয়ার পেছনে কারণগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের সেনারা শান্তি কমিশনের সদস্য হয়ে সিয়েরা লিওনে বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার যে প্রসার ঘটিয়ে এসেছিলেন, তা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কেননা, সুসম্পর্ক বজায় রাখার পথগুলো এখনও ঝাপসা।

  • 2
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে