২০০০ বছর ধরে পরিত্যক্ত এই নগরী

প্রকাশিত: ২৮-১১-২০২০, সময়: ১৩:৪৭ |
Share This

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিশ্বের অনেক দেশেই হয়েছে পরিত্যক্ত অনেক শহর। যা একসময় ছিল জাকজমক নগরী। যে শহরের রাস্তা সারাদিন মানুষের পদচারনায় মুখর থাকত। কালের বিবর্তনে তা আজ শুধুই স্মৃতি। তেমনই একটি নগরী হেগ্রা। নাহ মিশর বা ইউরোপের কোনো দেশে নয়। এই নগরী রয়েছে এশিয়ায়।

সৌদি আরবের আল-উলা শহরের উত্তরে খোদাইকৃত পাথর ও প্রাসাদের জন্য বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক শহর হেগ্রা। এ অঞ্চলকে মাদা’য়েন সালেহ এবং আল- হিজর নামেও ডাকা হয়। প্রায় দুই হাজার বছর জনমানবহীন থাকার পর প্রথম বারের মতো পর্যটকদের জন্য প্রাচীন এই শহরটি উন্মুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব।

এ শহর একসময় জমজমাট বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে ১০৬ খ্রিস্টাব্দ বছর পর্যন্ত টিকে থাকা নবতায়িয়ান সভ্যতার দ্বিতীয় রাজধানী ছিল হেগ্রা। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে পরিত্যক্ত এ অঞ্চল ছিল অন্য আর দশটা নগরীর মতোই ব্যস্ত নগরী। নবতায়িয়ান শাসকরা বর্তমান জর্ডানের পেত্রা নগরী থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এ অঞ্চলের স্থাপত্যগুলো মেসোপটেমীয় ও গ্রীক সভ্যতা থেকে অনুপ্রাণিত। নবতায়িয়ান সভ্যতা পাথরের খোদাই করা কাজ ও স্মৃতিস্তম্ভের জন্য বিখ্যাত। হেগ্রাই সৌদি আরবের প্রথম ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল।

একই সভ্যতার অংশ হওয়ায় পেত্রা ও হেগ্রার স্থাপত্যের মধ্যে অনেক মিল দেখা যায়। বর্তমানে প্রতিবছর ১০ লাখ পর্যটক পেত্রা ভ্রমণ করেন। প্রথম বারের মতো হেগ্রা উন্মুক্ত করে দেয়া হলেও, এ অঞ্চলে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস এখনো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। অনেকে হয়তো কখনো রহস্যময় ও আকর্ষণীয় নবতায়িয়ান সভ্যতার নামই শোনেনি। নবতায়িয়ানরা ছিল মূলত মরুভূমিতে বসবাসকারী যাযাবর জাতি, পরবর্তীতে তারা এ অঞ্চলে বাণিজ্য প্রসারেও ভূমিকা রাখে। সৌদি আরব ও জর্ডান হয়ে মিশর, সিরিয়া ও মেসোপটেমীয় অঞ্চলে ধূপ ও মশলা বিক্রি করতো। গোলমরিচ, আদা, চিনি ও তুলার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য গুরূত্বপূর্ণ বিভিন্ন সুগন্ধিও বিক্রি করতো তারা।

১০৬ খ্রিস্টাব্দের পর রোমানরা বর্তমান জর্ডান, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, সৌদি আরবের একাংশ, ইজরাইল ও সিরিয়ায় তাদের দখল করে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করার পর-ই ধীরে ধীরে নবতিয় সভ্যতা হারিয়ে যায়। নবতায়িয়ান সভ্যতার তেমন কোনো লিখিত দলিল না থাকায় তাদের ইতিহাস সম্পর্কেও বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।

বর্তমানে আমরা এই সভ্যতার ব্যাপারে যা কিছুই জানি তা প্রাচীন গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় দলিল থেকেই। পেত্রার মতোই একসময়ের জমজমাট নগরী হেগ্রা সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত টিকে থাকা বেশিরভাগ স্থাপত্যই সমাধিক্ষেত্র। শহরটির বেশিরভাগ স্থাপত্যই সময়ের পরিক্রমায় মরুভূমির বালির গহ্বরেই হারিয়ে গেছে।

তাদের ইতিহাস অস্পষ্ট হয়ে গেলেও নবতায়িয়ান স্থাপত্যবিদ্যা ও হাইড্রোলিক প্রকৌশলে পথিকৃৎ ছিল। হাজার হাজার বছর পূর্বে তারা মরুভূমিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি পাইপের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে জলাশয় তৈরি করতেন। সমাধিক্ষেত্রের চারপাশে পানির লাইনের মাধ্যমে সম্মুখ দরজা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, একারণেই হাজার হাজার বছর পরও টিকে আছে এই স্থাপত্যগুলো।

হেগ্রায় এখনো খোদাই করা ১১১টি সমাধিস্তম্ভ টিকে আছে। নবতায়িয়ান সভ্যতার রাজধানী পেত্রায় ৬০০টির বেশি সমাধিস্তম্ভ থাকলেও, হেগ্রার স্তম্ভ গুলোই এখনো অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। পর্যটকরা এই রহস্যময় সভ্যতার নিদর্শন আরও ভালোভাবে দেখতে পাবেন। স্থাপত্যে রোমান ও গ্রিক সভ্যতার অনুপ্রেরণাও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। গ্রিক, রোমান, মিশরীয় ও পারস্য সভ্যতার গুরূত্বপূর্ণ প্রতীক স্ফিংক্স ও গ্রিফিনের ভাষ্কর্যও আছে সমাধিক্ষেত্রের প্রবেশদ্বারে।

স্থাপত্যগুলোর শিলালিপিতে সময়ের বর্ণনাও পাওয়া যায়। হেগ্রার সবচেয়ে প্রাচীন সমাধিস্তম্ভ ক্রিস্টপূর্ব ১ সালের এবং খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে নতুন স্তম্ভটি ৭০ ক্রিস্টাব্দের। তবে তারপরও এ সভ্যতার সময়কাল নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্কের অবসান হয়নি। এই সমাধিস্তম্ভের পেছনের সম্পূর্ণ গল্প এখনো অজানা রয়ে গেছে। হেগ্রার সর্ব বৃহৎ স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৭২ ফুট, শুধু একটি পাথর খোদাই করেই এই স্তম্ভটি নির্মিত হয়। স্তম্ভটির নাম কাসর আল-ফরিদ যার অর্থ নিঃসঙ্গ প্রাসাদ। অন্যান্য স্তম্ভগুলো থেকে দূরবর্তী হওয়ায়ই এই নাম দেয়া হয়।

সৌদি আরব পর্যটনের জন্য হেগ্রা উনুক্ত করে দেয়ায় এর নতুন ইতিহাস শুরু হতে যাচ্ছে। এর আগে প্রতিবছর দেশটির ৫ হাজার নাগরিক হেগ্রা ভ্রমণের অনুমতি পেতো। বিদেশী পর্যটকদের জন্য সরকার থেকে বিশেষ অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হতো, তাও প্রতিবছর ১ হাজারের বেশি মানুষ অনুমতি পেতো না। তবে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এখন ৯৫ রিয়ালের (২৫ ডলার) টিকিট কিনেই প্রবেশ করা যাবে রহস্যময় সভ্যতার প্রাচীন এই নগরীতে।

  • 6
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে