রেশমা নাহার রত্না: এভারেস্ট ছুঁতে চাওয়া প্রাণ পিষ্ট হলো ঢাকার রাস্তায়

প্রকাশিত: ০৮-০৮-২০২০, সময়: ১৫:৩৮ |
Share This

রুদ্র আরিফ :
সাত মহাদেশের সাত শীর্ষ পর্বতচূড়া জয়ের লক্ষ্যে নিরন্তর দেশ-বিদেশ চষে বেড়ানো এভারেস্টজয়ী অভিযাত্রী ওয়াসফিয়া নাজনীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ঢাকার রাস্তা পার হওয়াই তার কাছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়।

সেই আশঙ্কা আরও একবার নির্মম বাস্তব হয়ে ওঠল। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর সংসদ ভবন এলাকার চন্দ্রিমা উদ্যান সংলগ্ন লেক রোডে সাইক্লিং করার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ দিলেন পর্বতারোহী রেশমা নাহার রত্না। তার মৃত্যুতে আরও একবার সড়কে নিরাপত্তার বিষয়টি বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠল।

৩৩ বছর বয়সী রত্না ছিলেন একাধারে পর্বতারোহী, দৌড়বিদ ও সাইক্লিস্ট। এছাড়া ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৬ সালে বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত কেওক্রাডং পর্বত চূড়ায় ওঠার মাধ্যমে পর্বতারোহন শুরু করেন তিনি।

গত বছরের আগস্টে ভারতের লাদাখের স্টক কাংরি (৬১৫৩ মিটার) ও কাং ইয়াস্তে-২ (৬২৫০ মিটার) পর্বত দুটিতে সফলভাবে সামিট করেন রত্না। এ সময় বাংলাদেশের পতাকা বহন করেন তিনি।

এছাড়া ২০১৮ সালের আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত- মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত- মাউন্ট কেনিয়া অভিযানেও তিনি অংশ নেন।

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ক্লাসে অংশ নেওয়ার কথা ছিল

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক (প্রোগ্রাম) মেজবাহ উদ্দীন সুমন জানান, রত্না ছিলেন কেন্দ্রের ‘আলোর ইশকুল’ প্রোগ্রামের সক্রিয় সদস্য। কেন্দ্রে তিনি নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। শুক্রবার সাড়ে নয়টায় কেন্দ্রের একটি অনলাইন (জুম) ক্লাসে তার অংশ নেওয়ার কথা ছিল।

সাড়ে ১০টার দিকে তার দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর আসায় ওই ক্লাস স্থগিত করা হয়। হাসপাতালে ছুটে যান সুমন। তার পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।

সুমন বলেন, এভারেস্ট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন রত্না। তিনি নিয়মিত একটি দলের সঙ্গে সকালে হাতিরপুলে দৌড়াতেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেখান থেকেই সাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।

রত্নার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নড়াইলের লোহাগড়ায়। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন শিকদার বীর বিক্রম। লোহাগড়া আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে রাজধানীর ইডেন কলেজে উচ্চ শিক্ষার পাঠ শেষ করেছিলেন রত্না।

শিশুদের এ পথে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন

বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহন প্রশিক্ষক ও পর্বতারোহী মীর শামসুল আলম বাবু  জানান, পর্বতারোহনে রত্নার প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি শুরুতে বাংলাদেশ মাউন্টেইনিং ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন। সেখানেই বেসিক কোর্স করেন। পরবর্তীকালে নিজে নিজেই এ পথে এগিয়ে যান। প্রশিক্ষণ নেন ভারতে। গড়েছিলেন একটি দলও।

শিক্ষিকা ছিলেন বলে শিশুদের মনোজগত খুব ভালো বুঝতেন রত্না। শিশুদের পর্বতারোহনে আগ্রহী ও যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে একটি উদ্যোগও হাতে নিয়েছিলেন। তার অকালপ্রয়াণে সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল বলে জানান বাবু।

এছাড়া চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে ফেসবুকে পর্বতারোহীদের নিয়ে একটি লাইভ শো সঞ্চালনা করতেন রত্না।

হাসপাতালে অনুজ পর্বতারোহী রত্নার মৃতদেহ দেখে এসে দীর্ঘশ্বাস ভরা কণ্ঠে বাবু বলেন, ‘কোভিড-১৯ না এলে এতদিনে হয়তো আরও কোনো সামিট করে ফেলত সে।’


পাহাড়ের ডাক…

২০১৬ সালে কেওক্রাডং জয়ের পর, সে বছরই নিজেকে পর্বতারোহী হিসেবে আরও প্রস্তুত করতে ভারতের উত্তর প্রদেশের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনারিংয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ নেন রত্না। তবে প্রত্যাশিত ফল না আসায় পরের বছর দ্বিতীয়বারের মতো প্রশিক্ষণ নেন।

২০১৮ সালে তিনি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০৫৭ ফুট উচ্চতায় আফ্রিকার কেনিয়ার পর্বত চূড়া লেনানা পিক সামিট করেন।

লাদাখের পাহাড়ে…

২০১৯ সালের ৮ আগস্ট, ভারতের লাদাখের মারাখা ভ্যালির কাং ইয়াস্তে-২ মাউন্টেন রোড থেকে অভিযান শুরু করেন তিনি। আবহাওয়া প্রতিকূল ছিল তখন। পাহাড় বেয়ে নামা পানির স্রোত তার অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই অনুকূল আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

এরপর ২২ আগস্ট যাত্রা শুরু করেন স্টক কাংরি পর্বতের উদ্দেশে। ২৩ আগস্ট কাংরি বেসক্যাম্পে পৌঁছেন এবং বিকেল সাড়ে ৫টায় সামিটের উদ্দেশ্যে পা বাড়ান। ততক্ষণে পায়ে ভয়ঙ্কর রকমের ফোসকা পড়ে যায় তার। তবু থামেননি। সারা রাত ট্রেক করে ভোর ৫টায় সামিট করেন সেন্ট কাংরিতে। তার হাতে তখন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।

এরপর আবার বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন ২৫ আগস্ট। সেদিন বিশ্রাম নিয়ে, ২৭ আগস্ট আবার পৌঁছেন ছাকদোতে; উদ্দেশ্য- কাং ইয়াস্তের চূড়ায় উঠবেন। সফলও হন ৩০ আগস্ট।

ম্যারাথন…

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেওয়াও ছিল তার স্বপ্ন। নিয়েছেনও।

ভয়েস অব আমেরিয়ার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রত্না বলেছিলেন, ‘একজন শাড়ি পড়া বাঙালি নারীর পক্ষে স্কুল শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্পটা হয়তো অতটা বৈচিত্র্যময় নয়। কিন্তু একজন পর্বতারোহী হয়ে ওঠার গল্পটার মধ্যে রয়েছে অনেক বেশি বৈচিত্র্য।’

নিজের জীবনসংগ্রাম ও বাধা পেরিয়ে আসার গল্প শুনিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘দিন শেষে আমরা কিন্তু পর্বতের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকাটাই ওড়াই।’ সেই স্বদেশের বুকেই দুর্ঘটনায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিতে হলো তাকে।

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
উপরে