প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে মাঠ প্রশাসন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২০; সময়: ২:১৪ অপরাহ্ণ |
প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে মাঠ প্রশাসন

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রভাবশালী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক নেতাদের নানা তদবিরের চাপে হিমশিম খাচ্ছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অযৌক্তিক ও অন্যায় আবদার মেটাতে অপারগ হলে তাদের বিরুদ্ধে হামলা এবং মামলার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) ওপর হামলা এবং বালুমহাল নিয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘটনায় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষোভ ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে কর্মরত ডিসি, ইউএনও এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তাদের ওপর প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় মামলা হলেও তার কোনো বিচার হয় না। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দেখতে পেয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। তাদের আইনের আওতায় আনতে হিমশিম খেতে হয়।

মাঝেমধ্যে দলের সিনিয়র নেতারাও দেনদরবার করে হামলাকারীদের রক্ষা করছেন। এমনকি পুলিশের ওপর হামলা করার পরও তাদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলা হলেও চাপ সৃষ্টি করে পুলিশকে ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

সম্প্রতি রাতের আঁধারে বাসভবনে ঢুকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। এ হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ নেতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গত ১৯ জানুয়ারি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হরিরামপুরে পদ্মা নদীর বালুমহাল পরিদর্শনে গেলে এসিল্যান্ড ইমরুল কায়েস, তার নিরাপত্তা প্রহরী পলিন ও গাড়িচালক রাজু বালুকারবারিদের হামলার শিকার হন। এ ঘটনায় উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পক্ষে সার্ভেয়ার শামসুল হক বাদী হয়ে ১৫ জনের নামে মামলা করেন।

গত ১৯ মে রাজশাহীর তানোর ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগ নেতাদের হামলায় গুরুতর আহত হন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাহবুর রহমান। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ তানোর পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহীন মোল্লাকে আটক করেছে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে যুবলীগ নামধারী একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এ সময় এ কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়। মৎস্য কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফ ও তার অফিস সহকারী দেলদার হোসেন গুরুতর আহত হন। তাদের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

গত ১১ মে সিলেট জেলা ছাগল উন্নয়ন খামার থেকে খাওয়ার জন্য ছাগল না পেয়ে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উপপরিচালক আমিনুল ইসলামের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটে।

৩০ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশের মাধাইনগর ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় ভূমি কর্মকর্তা আখতার হোসেন, অফিস সহকারী এসএম মনিরুল হক, অফিস সহায়ক শ্রী মঙ্গলা ও ঝাড়ূদার শফিকুল ইসলাম আহত হন।

গত ৪ মে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রাবনাবাদ নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালে হামলা করা হয়। পরে হামলাকারী লিটন গাজী ও রানা হোসেনকে আটক করে পুলিশ। গত ৫ জুন নীলফামারীর ডিমলায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর হামলা হয়।

মাঠ প্রশাসনে এ সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। করোনাভাইরাসে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা করা দরকার। সেটি না হলে প্রশাসনিক কাজে ব্যাহত হবে। জনগণও সেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চাপ ও তদবির সমস্যা সমাধানে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না।

যেনতেন প্রক্রিয়ায় যারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়েছেন, তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। ফলে তারা নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে চাইছেন। তাদের অনৈতিক আবদার না মানায় এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। তা না হলে মাঠ প্রশাসনে ইউএনওদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট হবে না। তিনি আরও বলেন, যখনই এমন ঘটনা ঘটে, তখনই হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। পরে এসব ঘটনা চাপা পড়ে যায়। সুতরাং সরকারের স্বচ্ছ সদিচ্ছা থাকতে হবে। তা না হলে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হতেই থাকবে। সূত্র- সমকাল

গত রোববার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের মধ্যে এক বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে সহকর্মীদের বিরুদ্ধে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা ও মামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি ইউএনওদের নিরাপত্তায় সাবেক মহকুমা প্রশাসক বা এসডিওদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল, তা বহাল করার জোর দাবি জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, শুধু ওয়াহিদা খানম নয়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটছে।

তিনি আরও বলেন, মাঠ প্রশাসনে ইউএনওরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রায়ই তাদের নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। অথচ আগে ইউএনওদের পূর্বসূরি এসডিওদের গানম্যান ও বাসায় হাউস গার্ডের ব্যবস্থা ছিল। এসডিও শব্দ বিলুপ্তির পর এ সুবিধাটি ইউএনওদের জন্য কার্যকর করা হয়নি। এখন থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য সেই আইন কার্যকর করার ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। এ আইন কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সব বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, ২০১৮ সালের ডিসি সম্মেলনে ইউএনওদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জননিরাপত্তা বিভাগকে যথাযথ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এতে সাবেক এসডিওরা যেভাবে ব্যক্তিগত ও বাসস্থানের নিরাপত্তা পেতেন, একইভাবে ইউএনওদেরও নিরাপত্তা দিতে বলা হয়েছে।

  • 74
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে