করোনা ঝুঁকি থেকে ১২ হাজার শ্রমিক মুক্ত হলেন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২০; সময়: ১০:০২ অপরাহ্ণ |
করোনা ঝুঁকি থেকে ১২ হাজার শ্রমিক মুক্ত হলেন

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের অনেক বড় প্রতিষ্ঠান গলদঘর্ম হলেও একটি ব্যাতিক্রমী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মিলেছে। মার্চ মাসের শুরুর দিকে দেশে করোনা সংক্রমন শুরু হলে অনেকের মতো তৈরী পোশাক শিল্পখাতের এ প্রতিষ্ঠানটিও তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু কারখানা খোলার পর ১২ হাজার কর্মীকে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়।

করোনা আক্রান্ত কর্মীদের আলাদা জায়গায় কোয়ারেন্টাইনে রেখে তাদের খাওয়া দাওয়াসহ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মোট ১৩’শ ৫৭ জন শ্রমিক প্রায় দুইমাস কোয়ারেন্টাইনে থাকলেও পরীক্ষায় মাত্র ১৪৩ জনের করোনা পজেটিভ পাওয়া যায়। নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে করোনায় আক্রান্তের হারও কমিয়ে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এই সময়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে কমবেশি ছাঁটাই হলেও গত দুইমাসে প্রতিষ্ঠানটির ৫টি ইউনিটে নতুন করে প্রায় ১৬’শ কর্মীর চাকুরি হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর বোর্ডবাজারে অবস্থিত হান্নান গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি ইউনিটে ১২ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করে। করোনার প্রকোপ শুরু হলে প্রকিষ্ঠানটির সকল কর্মীকে ছুটি দেয়া হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউন শিথিল করার পর ২৭শে এপ্রিল হান্নান গ্রুপের সকল প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। তবে প্রথম দুদিন প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদনের তেমন কাজ হয়নি। কর্মীদের মধ্যে নূন্যতম সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। কারখানার ডাম্পিং এরিয়াতে (যেখানে তৈরী পন্য রাখা হয়) ডাইনিং হলের চেয়ার টেবিল এনে কাজের ব্যবস্থা করা হয়। ডাইনিং হলকে ডাম্পিং এরিয়া বানানো হয়। এতে কর্মীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়ে যায়।

এত কর্মী নিয়ে কারখানা খোলার পর কর্তৃপক্ষের মাথাব্যাথা শুরু হয় কর্মীদের সুস্থতা নিয়ে। কারখানা খোলার আগে কয়েকজন নির্বাহী করোনায় আক্রান্ত হন। এর ফলে দুঃশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে কারখানা থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দুরে একটি ভবন ভাড়া করা হয়। সেখানে বিছানাপত্রসহ সকল ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। কোম্পানির চেয়ারম্যান এবিএম সামছুদ্দিন জানান, কারখানা খোলার প্রথম দিন থেকে কর্মীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা শুরু হয়। তাপমাত্রা বেশি হলে ওই কর্মীকে কিছু ঔষুধসহ দুদিনের ছুটি দিয়ে বাসায় থাকতে বলা হয়। দুদিনে তার তাপমাত্রা না কমলে তাকে কোম্পানির নির্দিষ্ট কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়।

তিনি আরো বলেন, করোনা উপসর্গ দেখা দিলেই আমরা তাদেরকে কোয়রেন্টাইন সেন্টারে পাঠিয়েছি। এভাবে ১৩’শ ৫৭ জন কর্মীর জন্য মোট ৯টি সেন্টার খুলতে হয়েছে।

কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালানো ছিলো একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রতিদিন ৯টি সেন্টারে রান্না করা খাবার এবং পানি সরবরাহ করতে হয়েছে। সবাই যাতে পর্যাপ্ত গরম পানি খেতে পারে এবং গরগরা করার কাজে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য ১৪’শ ফ্লাক্স দেয়া হয়েছে। আদা, লেবু, এলাচি, দারুচিনি সরবরাহ করা হয়েছে প্রত্যেকটি সেন্টারে। প্রতিদিন কোম্পানির ৬জন ডাক্তার এবং কয়েকজন নার্স রোগীদের অবস্থা পর্যবেক্ষন করতেন। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যাদের উপসর্গ কম আছে তাদেরকে আলাদা করে দেয়া হবে। করোনার সবগুলো লক্ষন আছে এমন রোগীদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। মোট ৬’শ ৭০ জনের টেস্ট করে ১৪৩ জনের ফল পজেটিভ আসে।

ডাক্তাররা কারখানা কর্তৃপক্ষকে জানান, কোয়ারেন্টাইনে থাকা কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের ভেষজ খাওয়ানোর ফলে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে।

হান্নান গ্রুপের চেয়ারম্যান এবিএম সামছুদ্দিন বলেন, কোয়ারেন্টাইন সেন্টারগুলো চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো। বিশেষ করে স্থানীয় লোকজনের বিরোধিতার কারণে আমরা কারখানার কাছাকাছি সেন্টার ভাড়া নিতে পারিনি। এছাড়া সেন্টারগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাঠাতে কর্মকর্তাদের বেগ পেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, এতগুলো কর্মী যাতে একসাথে কারখানায় প্রবেশ করতে না হয় সেজন্য পুরুষ এবং নারীদের আলাদা সময়ে ( আধাঘন্টা আগে ও পরে) প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। ছুটির সময়ও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে কর্মীরা যখন প্রবেশ করে তখন সবার শরীরের তাপমাত্রা নেয়া হয়। এছাড়া দুপুরে এবং বিকেলে সবার আরো দুই দফা তাপমাত্রা নেয়া হয়। কারো শরীরের তাপমাত্রা বেশি হলে তাকে দুদিনের ছুটি দিয়েছি আমরা। পরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কাজে যোগদান করতে দেই। করোনা থেকে সুস্থ রাখার জন্য কারখানায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিপুল হ্যান্ড স্যানেটাইজার তৈরী করা হয়েছে।

১৩’শ ৫৭ জন কর্মী কোয়ারেন্টাইনে থাকার কারণে তারা একদিনের বেতন থেকেও বঞ্চিত হয়নি বলে জানিয়েছেন কোম্পানির নির্বাহীরা। এমনকি তাদেরকে হাজিরা বোনাসসহ পুরো বোনাস দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ৬০ শতাংশ বেতন দিয়েছে।

কোম্পানির চেয়ারম্যান বলেন, কর্মীদের যত্ন নেয়ার কারণে কারখানার অন্য কর্মীদের মাঝে কাজের স্পৃহা বেড়েছে।

কারখানার অপারেটর শিমু করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, শরীরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আমাকে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে খাওয়া দাওয়াসহ সব ধরনের ঔষুধ দেয়া হয়েছে। এক মাস ১৬ দিনে আমার রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। এরমধ্যে সকল বেতনভাতা আমি পেয়েছি।

সুপারভাইজার এমদাদুল ইসলাম বলেন, করোনা পজিটিভ হবার পর আলাদা ছিলাম। কাজে ফেরার পর কারখানার পরিবেশ নিয়ে আমরা বেশ সন্তুষ্ট। কোম্পানির পক্ষ থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার , মাস্ক এবং অন্যান্য উপকরন সরবরাহ করা হয়েছে।

কোম্পানির নিয়মিত নার্স শিখা বলেন, প্রথম প্রথম ভয় পেয়েছিলাম। পরে কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ অন্যান্যদের সাথে নিয়ে সাহসিকতার সাথে করোনা মোকাবেলা করেছি। সবাই একসাথে কাজ করার ফলে কারখানার উৎপাদনও ব্যহত হয়নি।

উল্লেখ্য, হান্নান গ্রুপ মূলত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নামকরা ক্রেতাদের কাছে পোশাক বিক্রি করে। কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৮০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

  • 43
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে