পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও, একবছরের মধ্যে দেশের সবাইকে দেওয়া সম্ভব হবে না

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২০; সময়: ১:৫২ অপরাহ্ণ |
পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পাওয়া গেলেও, একবছরের মধ্যে দেশের সবাইকে দেওয়া সম্ভব হবে না

সাদিকুর রহমান : বাংলাদেশ যদি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিদেশি উৎসের তৈরি কোভিড টিকা পায়, তাহলে কি দেশের সবাইকে একবছরের মধ্যে তা দেওয়া যাবে? উত্তর হচ্ছে; না।

প্রাণঘাতি সার্স কোভ-২ জীবাণুর বিস্তার রোধে প্রয়োজন দেশের প্রত্যেক প্রান্তে তা পৌঁছে দেওয়া। এবং সেটাও করতে হবে ইতোপূর্বে যেকোনো টিকাদান কর্মসূচীর চাইতে নজিরবিহীন দ্রুতগতিতে আর ব্যাপক আকারে। আর সমস্যাটা সেখানেই।

প্রতিবছর ৪০ লাখ শিশুকে নানা প্রকার রোগী প্রতিরোধী টিকাদানে অভ্যস্ত আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এটাই সম্ভবত আমাদের সর্বোচ্চ গণটিকা দানের সক্ষমতা।

এ গতিতে চললে সকল বয়সের মানুষকে কোভিড টিকার আওতায় আনতে ১০ বছর সময় লাগবে। এমনটাই অভিমত দেশের বিশেষজ্ঞ মহলের।

কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সবাইকে সুরক্ষা দিতে হলে- দেশের সম্পূর্ণ টিকাদান কর্মসূচীকে নতুন পরিকল্পনার আওতায় ঢেলে সাজাতে হবে। বিশেষ করে, গুরুত্ব দিতে হবে ভ্যাকসিন সংরক্ষণে ব্যবহৃত হিম চক্রকে, এমনটাই বলছেন তারা।

সম্প্রতি বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় ও হ্যারিয়ট-ওয়াট বিশ্ববিদ্যালয় তাদের এক গবেষণায় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে। গবেষণার লক্ষ্য, দেশের টিকাদান সক্ষমতা নিরূপণ এবং টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহনের হিমায়িতকরণ চক্রের অবস্থা যাচাই।

যুক্তরাজ্য সরকারের গবেষণা ও উদ্ভাবনা সংস্থা দেড় বছর মেয়াদি এ গবেষণায় সাহায্য করছে। এর মাধ্যমে, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে কোভিড টিকা বিতরণের মূল নকশা প্রণয়ন করা হবে, যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সকলের জন্য গণটিকা কার্যক্রম গ্রহণে সহায়ক হতে পারে।

হিমায়িতকরণ চক্র বলতে বোঝায়; তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণ পদ্ধতিতে টিকার ডোজ সংরক্ষণ এবং সরবরাহ ব্যবস্থা। এজন্য সূক্ষ্ম পরিকল্পনা যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রকৃত ও কার্যকর পদক্ষেপের ধারাবাহিক সমন্বয়। পুরো ব্যবস্থাটির মেয়াদে তাপমাত্রায় বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটলেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে জীবনদায়ী অমূল্য ভ্যাকসিন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অর্থনীতির অধ্যাপক ফারজানা মুন্সি- টিকা সক্ষমতা যাচাইয়ের দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক প্রকল্পের আওতায় একজন সহ-গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, ”এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই হলো কোভিড-১৯ এর গণটিকা কর্মসূচীর জন্য বাংলাদেশে বিশাল আকারের যে কোল্ড চেইন বা হিমায়িতকরণ ব্যবস্থা দরকার তার সুষ্ঠু ও ফলপ্রসূ পরিকল্পনা করা। সফল টিকাদানের জন্য এ চক্রটির সহজলভ্যতা এবং প্রস্তুতি অপরিহার্য।”

বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারক শিল্প আছে। আছে ভ্যাকসিন উৎপাদনের ব্যবস্থাও। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) আর গ্যাভি জোটের আওতায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কোভিড প্রতিরোধী টিকা সরবরাহ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদনেও সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

সে টিকা যদি আসেও, তাহলে সবাই কীভাবে তা পাবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কোল্ড চেইন কাঠামো উন্নয়নের গুরুত্ব উঠে আসে। দেশে মহামারি ছড়ানো ভাইরাস ঠেকাতে নজিরবিহীন মাত্রায় টিকা বিতরণের সক্ষমতা না থাকার বিষয়টি, তাই গবেষকদের উদ্বিগ্ন করছে।

হু’র গাইডলাইনের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ফারজানা বলেন, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনগুলোকে গুদামে সংরক্ষণ বা পরিবহনের সময় কমপক্ষে ২ থেকে ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। উৎপাদন থেকে শুরু করে কাউকে টিকা দেওয়ার আগপর্যন্ত সম্পূর্ণ ব্যবস্থায় তাপনিয়ন্ত্রিত এ কবচ টিকা বিতরণের প্রতিটি ধাপে থাকতে হবে।

দেশের বর্তমান অবকাঠামো দিয়ে, ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ৯৪% শিশুদের ডিপথেরিয়া, পের্টুসিস এবং টিটেনাস (ডিপিটি) ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। তবে, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুরা ২০১৮ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ শতাংশ বা ৪ কোটি ৪০ লাখ ছিল। এরপরও, সবাইকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

”কোভিড -১৯ টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রায় ১৬ কোটি ২০ লাখ জনকে দ্রুত টিকা দিতে হবে, যা বিদ্যমান টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন হবে,” ফারজানা বলেছিলেন।

তিনি জানান, চলমান গবেষণা প্রকল্পটি কোভিড -১৯ এর জন্য আঞ্চলিক, জাতীয় পর্যায়ে চিকিত্সা উপকরণ সরবরাহ শৃঙ্খলে সর্বাধিক টেকসই পরিবর্তন আনার বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের সহায়তা করবে। এ পরিবর্তন ভবিষ্যতে অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মহামারির সময়েও সহায়তা করবে।

হিমায়িতকরণ চক্র টিকা দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলাদেশের অনেক এগ্রামীণ জনপদে এখনও উপযুক্ত হিমায়িত পরিকাঠামো এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব রয়েছে।

এ ব্যাপারে বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ের শিক্ষক এবং প্রকৌশল অনুষদের ডিন প্রফেসর ইজাজ হোসাইন বলেন, ”কেন্দ্রীয় ডিপোগুলির সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ের বিতরণ কেন্দ্র এবং সেখানে ভ্যাকসিন পরিবহনের সময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয় হিমচক্রের মাধ্যমে। টেকসই ও ফলপ্রসূ চক্রের অভাবে বিপুল পরিমাণ টিকার ডোজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর ফলে অর্থের অপচয় এবং অকার্যকর টিকা ভুলবশত দেওয়ার ঝুঁকি দুটোই বাড়বে। তাছাড়া, হিমচক্রের অভাবে বিদেশ থেকে আসা ভ্যাকসিন সহায়তা নিয়েও আমরা বিপদে পড়তে পারি।”

টিকাদানে বাংলাদেশের বিদ্যমান সক্ষমতাকে তিনি একেবারেই সামান্য বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা এবং ভ্যাকসিন সংরক্ষণ নিয়ে প্রাথমিক যাচাই শেষ হওয়ার পর, প্রফেসর ইজাজ আলোচিত গবেষণার আওতায় তৃনমূল পর্যায়ে একটি টেকসই হিমচক্র সক্ষমতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় অংশ নেবেন।

এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক প্রফেসর টবি পিটারস জানান, ”টেকসই হিমচক্র বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে এবং বিদ্যমান টিকাদান অবকাঠামোকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ টিকাদানের সময় এর ব্যাপক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে পারবে।”

শুধু বাংলাদেশে নয়, সরবরাহ চক্রের এ রোডম্যাপ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচীকে সহায়তা করবে, বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

অনুবাদ: নূর মাজিদ

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

  • 32
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে