বদলে গেছে চাষ পদ্ধতি, বদলে গেছে দিন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২১; সময়: ১০:৫০ অপরাহ্ণ |
বদলে গেছে চাষ পদ্ধতি, বদলে গেছে দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বদলে গেছে চাষবাষের ধরন। ধান চাষের পাশাপাশি উচ্চফলনশীল সবজি ও ফল চাষে বদলে গেছে কৃষকের জীবনমান। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে এখন দ্বিগুণ ফলন পাওয়ার কথা বলছেন কৃষকরা। করোনাকালীন সময়েও বাড়ছে কর্মসংস্থান।

সহজলভ্য ও উন্নত কাঁচামাল মিলছে বলে গোদাগাড়ীর আমানতপুরে বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক-বিআইপি স্থাপন করেছে প্রাণ গ্রুপ। যে কারখানায় এখন আম, টমেটো সংগ্রহ ও পাল্প করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে আমানতপুরে ১০২ বিঘা জমিতে স্থাপিত এ কারখানা চালু হওয়ার পর কৃষকের পাশাপাশি বদলে গেছে এলাকার হতদরিদ্রদের সামাজিক অবস্থানও। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি এখন নারীরাও যুক্ত হয়েছেন টমেটো প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে; কেউ কেউ চাকরিও পেয়েছেন এ কারখানায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শাহাদাৎ হোসেন এখন মন দিয়েছেন কৃষিতে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ইফতেখার আহমেদ মুন্নাসহ আরও পাঁচ জন চাষি। মুন্না জানান, তারা ছয়জন ৪০ বিঘা জমিতে এখন মাচা পদ্ধতিতে বিপুল প্লাস, ভিএল জাতের টমেটো চাষ করছেন। মাচা পদ্ধতিতে চাষ করায় তাদের ফলন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

আগে মাটিতে চাষ করায় আমরা মৌসুম শেষে ফলন পেতাম ৫০ থেকে ৬০ টন। এখন আমরা ১২০ থেকে ১৩০ টন পর্যন্ত টমেটো পাই। বিঘাপ্রতি আমরা ২০০ থেকে ২৫০ টন টমেটো পাই। প্রতিদিন আমরা প্রাণের কারখানায় ৪ হাজার কেজি টমেটো পাঠাতে পারছি এখন। মুন্না জানান, আশ্বিনে বীজ বপনের পর ৭০ থেকে ৯০ দিনের মাথায় আসে টমেটোর ফলন। প্রতি বিঘা জমিতে তাদের খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা।

এলাকার কৃষকরা বলছেন, প্রাণের কারখানা স্থাপনের আগে এই চাষিরা তাদের উৎপাদিত টমেটোর বড় একটি অংশই ফেলে দিতে বাধ্য হতেন। বাজার মূল্যও পেতেন যৎসামান্য। এখন সেই দিন বদলে গেছে। কৃষকরা এখন শীতের শুরুতে প্রতি টন টমেটো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন স্থানীয় বাজারে।

গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান, আমানতপুরের প্রায় ২ দশমিক ৪৭ একর জমিতে টমেটো চাষ হচ্ছে এখন। তিনি বলেন, মাচা পদ্ধতিতে চাষ করায় টমেটোর ফলন যেমন বাড়ছে, তেমন গুণগত মানও কিন্তু বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাজার মূল্যও তারা বেশি পাচ্ছে।

আগে একটা দীর্ঘ সময় ছিল, এ এলাকার কৃষক কেবল ধান চাষই করতেন। তারা কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মূল্যটা পেতেন না। এখন আমরা হাই ভ্যালু ক্রপসের দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছি। অ্যালোভেরা, আমসহ এখন টমেটো চাষেও কৃষকদের আগ্রহী করছি। এক জমিতেই তারা নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করতে পারছে। অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হচ্ছি আমরা।

প্রাণের বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের উপ মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ মো. সারোয়ার হোসাইন জানান, গোদাগাড়ীতে প্রায় ৭ হাজার কৃষক প্রাণের সঙ্গে চুক্তি করেছে। প্রাণর চুক্তিভিত্তিক চাষিরা বিঘা প্রতি গড়ে ১০ টন অর্থাৎ ২৫০ মণ পর্যন্ত টমেটোর ফলন পেয়ে থাকেন। এসব টমেটো তারা বাজার মূল্যে কয়েক ধাপে বিক্রি করেন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিঘা প্রতি তাদের টমেটো বিক্রি হয় ১ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দরে। অন্যদিকে তাদের খরচ বিঘা প্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এতে তাদের বিঘা প্রতি মুনাফা আসে অন্তত ৫০ হাজার টাকা। প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষকরা সাধারণত ভিএল-৬৪২ জাতের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করেন। এতে সাধারণ জাতের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন পাওয়া যায়।

নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও দিনাজপুর জেলায় প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষকেরা টমেটো উৎপাদন করে থাকে। এ বছর প্রাণ’র প্রায় ১০,০০০ চুক্তিভিত্তিক কৃষক ৮৬৭ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছে। চলতি বছর তাদের টমেটো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১২,০০০ টন।

এর আগে ২০১৯-২০ সালে প্রাণের ৮ হাজার ৪০০ চুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রায় ৮০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছিল এবং টমেটো সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার টন। এছাড়া ২০১৮-১৯ সালে ৭৫০ বিঘা জমি থেকে প্রাণ এর ৭ হাজার ৫০০ হাজার চুক্তিভিত্তিক চাষির কাছ থেকে টমেটো সংগ্রহের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ হাজার টন। গত কয়েক বছরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষক বেড়েছে গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হারে।

সারোয়ার বলেন, এর বড় কারণ হল উপযুক্ত সময়ে চুক্তিভিত্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে টমেটো সংগ্রহ এবং অধিক ফলনের জন্য প্রাণের পক্ষ থেকে কৃষকদের সহায়তা।

তিনি জানান, প্রাণ কৃষকদের উন্নতজাতের বীজ প্রদান, জমি চাষে প্রশিক্ষণ ও সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এর সহযোগিতায় ‘প্রাণ অ্যাসিউরড স্কিমের আওতায়’ প্রাণ ২০০০ চুক্তিভিত্তিক টমেটো চাষিকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে।

সারোয়ার বলেন, চুক্তিভিত্তিক চাষের আওতায় কৃষকদের আগে থেকেই শতভাগ পণ্য ক্রয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এতে প্রান্তিক চাষিরা প্রাণের চুক্তির অধীনে আসায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন শাখার পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানিয়েছেন, দেশের বাইরেও প্রাণের সস-কেচাপের ভালো চাহিদা রয়েছে এবং ক্রমেই বাজার প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে সস, কেচাপ ও টমেটো পেস্টের বাজার বার্ষিক ২৫০ কোটি টাকার। এই বাজার বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। আর এই পণ্যের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাণ।

বছরে ১৮০০০ টন টমেটো সস উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে প্রাণ গ্রুপের। বর্তমানে প্রাণ সস-কেচাপ মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকা, ইতালি, সুইডেনসহ ৬০টি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। এই বাজার আরও বাড়াতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজশাহী ও নাটোরের প্রাণ’র দুটি কারখানায় ১৯ জানুয়ারি থেকে টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং শুরু হয়েছে; যা চলবে টমেটোর সরবরাহ থাকা পর্যন্ত। এ দুটি কারখানায় রয়েছে প্রায় ৫০০ স্থানীয় শ্রমিক। এছাড়া টমেটোর সরবরাহসহ বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত-এমন পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি লোকের।

প্রাণ কর্মকর্তারা জানান, কৃষকদের কাছ থেকে টমেটো কেনার পর কারখানায় প্রথমে সেগুলো গুণগত মান অনুযায়ী বাছাই (সর্টিং) করা হয়। এরপর স্বয়ংক্রিয় মেশিনে এগুলোকে নেওয়া হয় ওয়াশিং প্লান্টে। সেখানে কয়েক দফায় ওয়াশ করার পর টমেটো চলে যায় ক্রাসিং প্লান্টে। সেখানে টমেটো পেস্ট তৈরি হওয়ার পর সেগুলোকে অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী পেস্ট থেকে টমেটো সস্ ও কেচাপ তৈরি করা হয়।

সারোয়ার হোসাইন বলেন, প্রাণ সস্, কেচাপ ও টমেটো পেস্ট স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর। অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত পেস্ট দুই বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। তিনি জানান, আমানতপুরের কারখানায় এখন প্রতিদিন ৭ হাজার চুক্তিবদ্ধ কৃষক ২০০ থেকে ২৫০ টন টমেটো সরবরাহ করছেন। সূত্র- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

  • 87
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে